সালালাহ থেকে ফিরে - Salalah, Oman Tour
প্রায় ২ বছর আগে ওমানের রাজধানী মাসকেট ঘুরে আসা হয়েছিল। সেখানে আমার কিছু আত্মীয় পরিজন আছেন, এবারের মত ট্যুরটাও একই সময় ঈদের ছুটির মধ্যেই পড়েছিল। তখন আমার মামা কথায় কথায় সালালাহ্ এর কথা বলেছিলেন, অবশ্য গত ২০ বছরে উনি নিজেও বিভিন্ন কাজের ভিরে ঘুরে আসতে পারেননি।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_4999139509c349b3a4a0aaf0254b649a~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_4999139509c349b3a4a0aaf0254b649a~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg)
সালালাহ্ এর বিশেষ সময় কারীফ্ (মেঘলা নাতিশীতুষ্ণ) জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ৩-৪ মাস। তীল পরিমান জায়গা থাকে না রাস্তায় চলার, এত মানুষের ভীড় হয়।
আমি অবশ্য এই সবয়ের কিছুই জানিনা। শুধু শুনেছিলাম সালালাহ্ খুব সুন্দর একটি শহর, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, গরম কম তুলনা মূলক, সবুজের আবাস্থল। রাস্তায় গাড়িয়ে চালিয়ে যেতে ১২ ঘন্টা সময় লাগবে দুবাই থেকে এবং বড় গাড়ি হলে ভাল হয়। বড় ছোট টিলা, রাস্তায় কোথাও কোথাও ভাঙ্গা থাকার সম্ভাবনা থাকায় স্পোস্ট কারে যাওয়া হয়ত বা বাস্তবসম্মত হবে না। তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, যখন আমাদের পরিবারে মাঝারী সাইজের এস.ইউ.ভি আসবে তখনই যাব একবার ঘুরতে।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_82c6eb1f449140b59bdf02b6d793e9ab~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_82c6eb1f449140b59bdf02b6d793e9ab~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg)
এবার রমজানের ঈদের ছুটির পরিকল্পনা করলাম, সাথে এক বন্ধু এবং পরিবার নিয়ে বের হয়ে পড়লাম অনেকটা অজানার উদ্দেশ্যে। অজানা বলছি কারণ সালালাহ সম্পর্কে তেমন বেশি কিছুই জানিনা, জানি না রাস্তা ঘাটের পরিবেশ। যাওয়ার আগে হোটেলে রেট দেখলাম, প্রতি রাত ২৫ হাজার টাকা ভাড়া চলছে তিন তারকা হোটেলের। ভাবছিলাম ৩ দিনের জন্য বুক করব। হঠাৎ ওমান থেকে দাদু ফোন করে বললেন উনি আমাদের দেখতে চান। ভেবেছিলাম প্রথমে মসকেট যাব, সেখান থেকে সালালাহ্। মামার সাথে কথা হল, মামা আমাদের হোটেল বুক না করতে বললেন। উনিও আমাদের সাথে সালালাহ্ যাবেন তাই উনাদের পরিচিত পুরো ২২ জনের একটা টিম একটি ভিলা ভাড়া করছে। এও জানালেন, আমাদের সাথে সরাসরি সালালাহ দেখা হবে। মসকেট থেকে সালালাহ ১০ ঘন্টা ড্রাইভ, মামা হয়ত উনার গাড়ি নিয়ে যাবে নয়তঃ বাসে গিয়ে রেন্ট এ কার নিবেন।
ফারুকের সাথে সমস্ত প্লেন প্রোগ্রাম করে কাজগুলো গুছিয়ে নিলাম। ৬-৮ জুলাই তিন দিন অফিস বন্ধ। আমি পাঁচ তারিখ অফিস থেকে একটু আগে ভাগে এসেই ঘুম দিলাম ঘন্টা দুই। সন্ধ্যা ৭ টায় ঘুম ভাঙ্গলে ফারুকে ফোন দিলাম, জানাল সে ইফতার করছে, নামাজ পড়ে আসতে প্রায় ৯টা বাজবে। আমি চট জলদি উঠেই জীমে গেলাম, ঘন্টা দুই শারীরক কসরত সেরে বাসায় এসে গোসল করলাম। ততক্ষনে ফারুকও তৈরী হয়ে বাসার নিচে এসে অপেক্ষা করছে। আমার বৌ গত এক সপ্তাহ্ থেকে ব্যাগ গোচ্ছাচ্ছে। আমিও ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাজার সদায় করলাম, বিশেষ করে কাপড় চোপড়। ইদানিং টি-সার্ট পড়ার খুব সখ চেপেছে। আমার অফিসের এক কলিগ সাংঘাতিক রকমের ফ্যাশন বাতিক আছে। মাসে বাংলাদেশি টাকায় ২৫-৩০ হাজার টাকার কাপড় চোপর না কিনলে তার আবার ভাল লাগেনা। অনেক সৌখিন একটা ছেলে।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_cf85706ddf9f4fcb97fc6304b5288fe5~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_cf85706ddf9f4fcb97fc6304b5288fe5~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg)
ফ্যাশনে আমার আগ্রহ থাকলেও ধারণা কম। মাঝে মাঝে মিটিং এর ফাঁকে তাকে সংঙ্গে নিয়ে ঘুরলাম দুবাই মল সহ কিছু বড় মলের দোকানে যেমন, H&M, PULL & BEAR এবং তার্কিস কাপড়ের দোকানে। বেশ কিছু টি শার্ট, কিছু ব্যতিক্রম জিনস্ কিনে রাখাছিল এই ট্রিপের জন্য্। ইদানিং জীমে বেশ সময় কাটাতেই বুঝলাম ভুড়ি একটা অবস্থানে চলে এসেছে তাই টি শার্টে খারাপ দেখাবে না। এই সুযোগে টি শার্ট পরার ভুতও মাথা থেকে নামবে।
বৌ বাচ্চার জন্য বাজার করল, যখন তার নিজের বেলায় কিনার পালা তখন মহা সংশয়। দাদু, মামারা কি ভাববেন, তাকে সেলোয়ার কামিজ পড়তে হবে অথবা শাড়ী। আমি তো সেই ঝাড়ি, তারে বোঝানোর চেষ্ঠা করলাম তুমি যা তাই, কাওকে দেখানো কাজ করতে নাই। তারা তোমাকে যদি ভালবাসে সেটা যে কোন পোষাকেই বাসবে। অনেক জোর জবরদস্তিতে টি শার্ট আর জীনস নিলাম তার জন্য।
তখন রাত ৯:৩০মিনিট ব্যাগ নিয়ে নিচে গেলাম, ৩ টা বড় সাইজের ব্যাগ, ২ টা ছোট সাইজের ব্যাগ, মেয়ের ট্রলি মিলিয়ে গাড়িতে ডিকির জায়গা সংকুলন সংশয় অবস্থা। যাই হউক, সময় কম, বেরুতে হবে। ঘামছিলাম খুব, গরম পড়ছে। হঠাৎ মনে পড়ল টাকা ভাঙ্গানো হয়নি। ওমানি রিয়েল নিতে হবে। আমরা দু’জন ভৌ দৌড়ে এক্সচেঞ্জে পৌঁছালাম টাকা চেঞ্জ করেই ফিরলাম ধ্রুত গাড়িতে।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_f576fbfad96241c0a6a09be106b543c2~mv2_d_1640_2400_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_1434,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_f576fbfad96241c0a6a09be106b543c2~mv2_d_1640_2400_s_2.jpg)
চলা শুরু করলাম, আল আইনের মাঝা মাঝি গিয়ে রাতের খাবার খেলাম। প্রায় ৩ ঘন্টা ড্রাইভ করার পর বর্ডারে পৌঁছালাম, মোবাইল জিপিএস আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ১টা ঘন্টা বেশি ঘুরিয়ে বর্ডারে নিয়ে গেল। বর্ডারে যেতে পাসপোর্ট গাড়ির কাগজ দেখিয়ে ইউএই ছাড়পত্র নিলাম। আবার ৩০ মিনিট যাওয়ার পর ওমানের বর্ডার থেকে ভিসা নিলাম, সাথে একটা ডাটা সিম নিলাম। যেখানেই যাই ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না, তাছাড়া জীপিএস ইন্টার নেট ছাড়া আই ফোনে চলে না, ছোট খাট হারামী আছে ওএস ডিভাইসগুলো। টাকা খসিয়ে সার্ভিস দেয়।
২ বছর আগে আমরা হাত্তা বর্ডার দিয়ে ওমান গিয়েছিলাম, তখন প্রায় ১০টা চেক পয়েন্টে আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করেছিল। এবার শুধু ২টা বর্ডার, একটি ইউই থেকে বেরুতে একটা ওমানে ঢুকতে এই যা। কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম, গাড়িতে গান চলছিল, আমার মেয়ে সেই খুশি সে টা টা যাচ্ছে (বেড়াতে যাচ্ছে)। সাধারণত আমি তাকে খুব বেশি সময় দিতে পারি না। এই রকম সময়গুলো সে খুব মজা করে, অনেকটা খুশিতে আটখানা থাকে।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_bbaf3206b8a6413297ea955ce075e060~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_bbaf3206b8a6413297ea955ce075e060~mv2_d_2400_1590_s_2.jpg)
ফারুক প্রায় ৪ ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি ওকে বিশ্রাম দিয়ে শুরু করলাম পথ চলা। সাধারণত দুবাই এর রাস্তায় পর্যাপ্ত লাইট থাকে। আমরা ওমানের যে রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছিলাম ৭ এবং ২৯ নাম্বার রাস্তার মাঝে মাঝে লাইট দেওয়া ছিল। মামার কাছে শুনেছিলাম রাস্তায় অনেক ট্রাফিক কেমেরা থাকবে তাই ১৩০ কিলোমিটারের উপর গাড়ি চালানো যাবে না। আমিও ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, একেত রাস্তায় আলো নাই, দ্বীতিয়ত টুওয়ে রোড (দু’পাশ থেকেই গাড়ি চলছিল, বাংলাদেশের সাধারণ রাস্তার মত), তৃতীয়ত কেমেরার পেনাল্টির ভয়। প্রায় ৩ ঘন্টা চালানোর পর সূর্য্য আকাশে লাল লাভায় দেখা দিচ্ছিল। ৬ তারিখ আরব দেশগুলোতে ঈদের নামাজ খুব সকালে হওয়ার কথা। ফারুককে একটি মসজিদের সামনে নামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম চোখ বন্ধ করে। নামাজ শেষে ফিরে আসতে আবার শুরু যাত্রা। আমি আরো ঘন্টা খানিক চালানোর পর ফারুক ড্রাইভিং শুরু করল। রাত প্রায় ১১টার দিকে খাবার খেয়েছি, বেলা শুরু থেকেই পেটে ছুচো নাচছে। রাস্তায় যতগুলো প্রেট্রোল পাম্পছিল প্রতিটা পাম্পে দাড়িয়েছি তেল নিয়েছি যখন দরকার হয়েছে, সাথে খাবারের খোঁজ জারী ছিল।
সব খাবারের দোকান বন্ধ, নামাজে গেছেন দোকানীরা, কখন খুলবে কেউ জানেনা। এত ক্ষুদা লাগছিল, মনে হচ্ছিল মাটি খাই। পানিও শেষের পথে, যাচ্ছি তো যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমি আর ফারুক ড্রাইভিং এর সীট বদল করছি। প্রায় দুপুর ১২টা নাগাদ একটি দোকান খোলা পাই। সোজা বাংলায় যা সামনে পেয়েছি তাই খেয়েছিলাম। ঐ একটি দোকানই খোলা পেয়েছিলাম। গরমের তাপে নাস্তানাবুদ, না ঘুমানোর কারণে মাথা ঘুরছিল। রাস্তায় তাপের তীব্রতায় দূর থেকে মনে হচ্ছিল ধুধু প্রান্তরে কেউ নদী বইয়ে দিয়েছি। সামনের গাড়ি গুলোকে মনে হচ্ছিল, পানির উপর বয়ে আসা কোন এক বস্তু। এটিকে বইয়ের ভাষায় মরুর মরিচিকা বলে। মামা মাঝে মাঝে ফোনে খবর নিচ্ছিলেন, মামী ওপাশ থেকে মামার পেছনে লেগে আছেন, কতটুকু পৌঁছেচে তারা? কিছু খেয়েছে কি, শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, যাক কেউ হয়ত আমাদের কথা চিন্তায় করছে, কঠিন পরিস্তিতে এক প্রকার ভাল লাগা কাজ করছিল।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_b9d819d8d4d4497cab52210bc0ade57c~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_b9d819d8d4d4497cab52210bc0ade57c~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg)
১৪ঘন্টা ড্রাইভ করার পর কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে নিজেকে গালি গালাজ করছিলাম, কেন যে ঈদের ছুটি মাটি করে এই মরুভূমির উপর মরতে আসলাম। কোথাও কেউ নেই, মাঝে মাঝে আর্মির ছোট চেক পোষ্ট দাঁড় করিয়ে চেক করছে। বেচেরা রোদের মধ্যে শুটকির মত শুকাচ্ছে দেখে মায়া হচ্ছিল। ভাবনায় বিরক্ত, মামা একটি ভিডিও পাঠালেন সেখানে বৃষ্টি দেখলাম। সামনে কয়েকশ কিলো মিটারে সূর্য্যের তেজের কমতি দেখছিনা। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল, হায় আমরা সামান্য বৃষ্টিটাও বোধ হয় হারালাম।
সালালাহ্ খুব কাছে আসতেই উঁচু পাহাড়ে চড়া শুরু করল গাড়ি। চেক পোষ্টে গাড়ি পার্ক করিয়ে কিছু কাগজ জমা করলাম। সেখানে সামান্য মেঘ আর প্রচন্ড বাতাস অনুভব করলাম। বাতাস ছিল নির্মল ঠান্ডা। মনে মনে ভাল লাগা কাজ করছিল। বর্ডার ক্রস করে সালালা ঢুকতেই মেঘের সাথে খেলা শুরু, গাড়ি ৪০ কিলোমিটার গতিতে যাচ্ছিল। ঠান্ডা বাতাস, মেঘের কুয়াশার কনা, না বৃষ্টি না মেঘ না কুয়াশা, সে এক অন্য কিছু। গাড়িটা পার্ক করে কিছুক্ষন ভিজলাম, শুধু আমি না, সম্ভবত যারা যাচ্ছিল ঐ রাস্তায় সবার আমাদের মত অবস্থা। এত ভাল কখনো লাগেনি, প্রকৃতির পা ছুঁয়ে সালাম করার সুযোগ থাকলে হয়ত আমি তাই করতাম, এত আরাম অনুভব করছিলাম যে চোখের কোনে কখন পানি চলে এল নিজেই বুঝিনি। সাংঘাতিক এক অবস্থা, পাহাড়ের এক পাশে ধুধু মরুভূমি অন্য পাশে মেঘ বৃষ্টি। স্রষ্টা একজন আছেন, তার এই লীলা খেলা যারা ঐ পরিস্থিতি দেখেনি বুঝানো যাবে না।
মামাকে ফোন দিলাম, জানালাম আমরা কাছেই পৌঁছেছি। ওনারা অবশ্য বিশ্রামের পর ঘুরতে বের হয়েছেন, ইটনিন নামে একটা জায়গায়। আমরা খুব ক্লান্ত, একটি ভাল খাবারের দোকানের খোঁজে ছিলাম, পেয়েও গেলাম হোটেল কাছে। বাঙ্গালী আর আরবী খাবারের মিশ্রন। পেট পুঁজা করে রুমে ঢুকলাম।
একটা গোসল দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে কেউ আমারে গালে হাত রেখেছে, বুঝেই উঠে বসলাম। দেখলাম আমার মামাতো বোন, মাথা ঝিম ঝিম করছে। তবুও ভাল লাগছে, ফারুককে জাগিয়ে দিলাম। সবার সাথে পরিচয় হল কথা বার্তা শুরু; যেন এক মিলন মেলা।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_c7da2742c95642169da75a6bb126cf00~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_c7da2742c95642169da75a6bb126cf00~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg)
গাঁয়ের পরিবার থেকে দুরে আছি অনেক বছর। গত ৮ বছরে নিজের বিয়ে ছাড়া কোন আত্মীয়ের বিয়েতে আনাগোনা হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। ঐ রকম সবাইকে নিয়ে হই হুল্লোড করার মজাই অন্য রকম, যারা বিশেষ করে আমাদের মত বিদেশে শ্রম বিক্রী করে খাই, তাদের মিলন মেলার সুযোগ হাতো গোনা মাত্র।
মাথাটা টাল মাটাল ঘুরছিল, ঘুম পুরোপুরি হয়নি। সেরিডন হাতে নিয়ে ফারুক সহ বের হলাম। নিচে একটি দোকান থেকে পানীর ছোট বতল কিনে সেরিডন ঝাঁকিয়ে গুলিয়ে নিলাম। আমি কিছুটা, ফারুক কিছুটা আর বাকীটা লিমাকে খেতে দিলাম মাথা ব্যাথা কাটানোর জন্য। মামা ঢেকে পাঠালেন, রাত্রে উনাদের ইসকন এর এক অনুষ্ঠান আছে। আমাদের সাথে যেতে বললেন, আমি লিমা আর লিয়াকে পাঠিয়ে দিলাম।
ফারুক সহ বের হলাম শহরটা একটু ঘুরে দেখতে। গাড়িটি প্রধান সড়কে তুলতেই পাশে সাড়ি সাড়ি ফলের দোকান, ডাব, কলা, আখ আর কতকি। একটু যেতেই চোখে পড়ল কলাগাছের বাগান, সামনে যেতেই নারিকেলের বাগান। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশেই তাজা কলা খাওয়া শুরু করলাম, সাথে ডাব। হুম.. সত্যিই তাজা.. ডাবের ভেতর নারিকেলের হালকা সাদা আশ, দারুন খেতে লাগছিল।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর, লিমা মামার ফোন থেকে জানালো লেয়া খুবই দুষ্ঠামী করছে, রাখা দায় হয়ে পড়েছে। উপায়ান্ত না দেখে তারা যেখানে আছে সেখানে যাওয়ার চেষ্ঠা করলাম। মজার বিষয় কেউ তাদের ঠিকানা ঠিক মত বলতে পারছিলনা। বিরক্ত লাগছিল ঠিকানা খুঁজে পুরো শহর চষে বেড়াচ্ছিলাম। শেষ মেষ মামাদের পরিচিত এক ভক্ত আমাদের ওয়াটসাপ এপ এ লোকেশন পাঠালো। গুগুল থেকে সহযোগীতা নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছালাম, এবং তাদের নিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
আজ খুব ক্লান্ত, কিছু বাজার করা বাকি ছিল, আমরা দু’জন বের হয়ে তা সারলাম সাথে হোটেল থেকে খেয়ে ফিরলাম। ৭ ঘন্টার একটা ঘুম দিয়ে সকাল ৭:৩০ মিনিটে ঘুম ভাঙ্গল, জানালার পর্দা সরাতেই বুঝতে পারলাম বাইরে গাঢ় কুয়াশা বিন্দু বিন্দু জল। অদ্ভুদ ভাল লাগল, আজ আমরা মামাদের টিমের সাথে শহরটা ঘুরে দেখতে বের হব বলেই কথা ছিল। চট জলদি সবাইকে রেডি করিয়ে নাস্তা করলাম রেষ্টুরেন্টে। সস্তা খাবার কিন্তু ভাল ছিল। ডিম, ডাল, পরটা… জুস এবং চা। বের হলাম মামাদের টিমের সাথে। আমার দাদুকে নিলাম সাথে, আমি আজ ড্রাইভ করলাম পুরো রাস্তা, কথা আছে আগামী কাল পুরোটা সময় ফারুক ড্রাইভ করবে।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_4bfff5b0c75c4319af4993f21807a67c~mv2_d_2400_1888_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_771,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_4bfff5b0c75c4319af4993f21807a67c~mv2_d_2400_1888_s_2.jpg)
দাদুর সাথে গল্প করছিলাম আর আমাদের সামনের গাড়িগুলোর পিছু নিচ্ছিলাম। Sadah নামে একটি জায়গায় গেলাম, যেখানে সমুদ্র, পাথরের পাহাড়, সবুজ, কুয়াশা, বৃষ্টি মিলে একাকার। খুবই সুন্দর একটি জায়গা। প্রায় ঘন্টা ৩ থেকে পাহাড়ের চুড়ায় গেলাম গাড়ি চেপে, মনে হচ্ছিল স্বর্গের এক টুকরো অংশ। দুপুর হতেই একটি পার্কে ফিরে এলাম, সবাই খেলাম। বাচ্চারা খেলা করল, আমরা তাদের সঙ্গ দিলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম, কিছু গল্প করলাম তারপর ঘুম। পরের দিন ৭টায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলাম সবাইকে, আজ আমাদের একা একা ঘোরাঘুরি করার কথা। মামারা একটি অনুষ্ঠানে যাবেন, আমার আপাতত কোন কোলাহল ভাল লাগছিলনা, তাছাড়া Ittin এ যাওয়া হয়নি, যার কারণে সালালাহ আসা। ৮:৩০ মিনিটে নাস্তা শেষে গাড়ি চেপে বসলাম, ফারুক ড্রাইভ করছিল, আমি আর আমার মেয়ে গাড়িতে চলা গানের সাথে গলা মেলাতে ব্যাস্ত ছিলাম। আবহাওয়াটাই পাগলাটে ছিল, বাইরে মেঘলা ঠান্ডা বাতাস, দুবাইতে কল্পনা করা যায়না।
Ittin এর কাছে ৫ কিঃমিঃ বাকী থাকতে কিছু দোকান রাস্তার ডান পাশে চোখ পড়ল, মনে হচ্ছিল বেতিক্রম কিছু চলছে। কিছু দোকান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল, বাইরে ছামড়া ছাড়ানো ছাগল ঝুলানো। কাছে যেতেই বুঝলাম মাংসের কাবাবের দোকান। পছন্দমত কোন একটি দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলাম, পাথরের উপর মাংস ফেলে রাখা আছে, নিচ থেকে আগুন বেরুচ্ছে, তেল চর্বিগুলো পাথর চুষে নিচ্ছে। দোকানের বেশিরভাগ কর্মচারী বাঙ্গালী। এই খাবারগুলো এখানকার লোকাল খাবার, ওমানী লোকালরা নাকি এখানে সকালের নাস্তা করতে চলে আসে। আমি খাওয়া শুরু করলাম… খাবারগুলো খুব বেশি সুস্বাদু ছিল বলবনা তবে স্বাস্থ্যকর ছিল।
Ittin Mountain কি, তা আমি ভাষায় বলে বুঝাতে পারব না। যারা আমার ছবিগুলো দেখছেন তারা কিছুটা ধারণা করতে পারবেন। মেঘ ছুঁয়েছিলাম.. গুহায় ঢুকেছিলাম... পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্য একজায়গায় যেন পুঞ্জিভূতছিল। মেয়ে সহ সবাই ইচ্ছা মত মেঘবৃষ্টিতে ভিজেছি। আমার বিশ্বাসছিল আমাদের শরীর খারাপ করবেনা এমনকি আমার ছোট্ট মেয়েটারও না। আসলেই তাই… ঐ আবহাওয়ায় সর্দি জ্বর হওয়ার কথা, কিন্তু সৃষ্ট্রা আর্শিবাদপুষ্ট ঐ মেঘ বৃষ্টিতে আমরা কোন ধরণে অসুস্থতা বোধ করিনি।
মামা ফোন দিয়ে মাঝে মাঝে খোঁজ নিচ্ছিলেন, কোথাই আছি কি করছি… আমরা ঐ দিন আরো দুইটা জায়গা ঘুরে বিকেলে মামার টিমের সাথে একত্রিত হলাম, খেলাম ঘুরালাম। বিকেলে মামার পরিবার তাদের টিম নিয়ে মসকেট ফিরে গেলেন। আমারও একই সময় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু না্হ মন কোন ভাবেই ফিরতে রাজী হচ্ছিল না। বস্কে একটি মেসেজ পাঠালাম, যে আগামী দুদিন অফিসে আসতে পারবনা মর্মে। বস এক কথায় বলল সমস্যা নাই। সাধারণত ছুটিতে গেলে একদিনতো দূরের কথা এক ঘন্টাও দেরী করিনা, সময়োত্তির্ণ হওয়ার আগেই কর্মস্থলে পৌঁছে যাই। এবার বিষয় ছিল একদম অন্যরকম।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_4c61b2d951d84e50b2c49e3d111469f6~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_4c61b2d951d84e50b2c49e3d111469f6~mv2_d_1920_1272_s_2.jpg)
রাত্রে বাইরে খেলাম, একটু শহরে ঘুরলাম। মামা যাওয়ার সময় খুব অনুরোধ করল যেন মসকেট একটা দিন ঘুরে যাই। দাদু খুব বেশি করে বলেছিলেন, বুড়ো মানুষ তাই ভাবলাম ফিরতি পথে মসকেট হয়ে যাওয়া যাবে। পরের দিন আরেক বার Ittin এ গেলাম সকাল ১০টার মধ্যে ঘুরা শেষ করে মসকেটের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। ১০ ঘন্টা গাড়ি চলল… এবার ঘন্টায় ১৬০ কিলোমিটার বা তারও বেশি গতিতে। গাড়ি যেন হাওয়ায় ভাসছিল। মামার বাসায় পৌঁছালাম রাত ৯টা নাগাদ। বাসা খুঁজতে বেগ পেতে হয়নি। গতবার যেখানে গিয়েছিলাম তার কাছেই ছিল। রাত্রে আলাপ করলাম। আমার মেয়ের সঙ্গি হল তার ছোট ছোট পিসিগুলো রাত ২টা পর্যন্ত কথা শেষ করে ঘুমোতে গেলাম।
সকাল ৮টা ঘুম থেকে উঠেই তৈরী হতে শুরু করলাম, রাস্তায় আবার সোহার হয়ে যেতে হবে। ফারুকের চাচা আর চাচাতো বোনের জামাই কে দেখে যাওয়ার কথা। তা ছাড়া আমার মামী শাশুরী ও মাসকেটের একটি হাসপাতালে ডাক্তার। উনার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যদিও উনার ডিউটিতে থাকলে দেখা হবে না।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_2fdfc5e8f3cc4e268415471b7a25e779~mv2_d_1920_1271_s_2.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_2fdfc5e8f3cc4e268415471b7a25e779~mv2_d_1920_1271_s_2.jpg)
নাস্তা শেষ করে মামী শাশুরীকে ফোন করতেই বুঝলাম উনি বের হতে পারবেন না। আমরা বিদায় নিয়ে বের হয়ে পড়লাম সোহারের উদ্দেশ্য, ২ ঘন্টা পর সোহার পৌঁছালাম, দুপুরেরর খাবার আমরা সেখানেই শেষ করলাম। আবার রওনা দিলাম দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে, সন্ধ্যা প্রায় ৭টা ঘরে এসে পৌঁছালাম।
মুদ্দা কথা যদি আমার আবার যাওয়ার সুযোগ থাকে সালালাহ আমি মিস করব না।
যারা মিডিলিষ্টে আছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, চোখের দেখা দেখে আসুন পৃথিবীর সৌন্দর্য্য। সৃষ্টা সৃষ্টি কত অদ্ভুদ, পাহারের এক পাশে ধুধু প্রান্তর অন্য পাশে মেঘ বৃষ্টি। হাইরে সৃষ্টি।
স্রষ্টাকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য।