top of page

Istanbul Turkey

ইস্তামবুলে ৭ দিন


ভাবনায় কখনো আসেনি ইস্তামবুলে পরিবার নিয়ে যাব, যখনই প্রথম পরিকল্পনা করেছিলুম। ইস্তামবুল যাবতো বন্ধুদের সাথে। শালা বন্ধুরা সেই পরিমাণ শঠ, যাবে বলে কথা দিয়েও, কয়েকবার তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছে। পরে ভাবলাম, বান্ধবীকে নিয়ে যাবো, কিন্তু সেই সুযোগের আগেই পাঁঠা বলি হয়ে গেলাম বিয়ের ঘন্টা গলায় নিয়ে।


আমার শেষের লিখা ইউরোপ ট্রিপে এ সম্পর্কে লিখেছিলাম, প্রথম ভ্রমনের আগ্রহই ছিল ইস্তামবুল। যাই হউক, বছরে ৩০ দিন (শুক্রবার ছাড়া) ছুটি মঞ্জুর থাকায়, ঘরে বসে ছুটির পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ইস্তাম্বুলে সময় কাটানোর একটা প্ল্যান তৈরী করা গেল।


ঘটনাটি অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে। ইস্তামবুলে যাওয়ার অন্য আরেকটি কারণও আছে। আমি যে মোবাইল নেটওয়ার্কটা ব্যবহার করি, তারা প্রতিমাসে ভাল মাসহারা পায় মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সুবিধার্থে। সেই হিসাবে আমায় খুশি করতে একটি রির্টাণ টিকেট অফার করে। কিছু শর্তছিল, টিকেটটি শুধু নিজে ব্যবহার করা যাবে, তিনটা শহরকে চিহ্নিত করতে হবে, তিনটা তারিখ নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু টিকেটটা বিনাপয়সায় ছিল, মনের ইচ্ছামত ৩টা দেশ এবং ৩টা আলাদা তারিখ লিখে ফর্ম ভরে জমা দিলাম। অনেকটা অন্ধকারে হাতড়ানো মত, ভাল কিছু আসলে ভাল, না আসলে পাতার গুড় পকেটে নিলে যা হয় সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরী ছিলাম। অনেকটা এই ভেবে “তারা মিথ্যাবাদী ছিল – আঙ্গুর ফল টক ছিল”।


১৫ দিন পরে আমার কাছে ফিরতি কল আসে, তথ্য যাচাই করে, তারপর তাদের পছন্দমত আমার পছন্দের লিষ্ট থেকে একটি টিকেট দেয়। ভাবলাম বৌ, মাঝে মাঝে খোঁচা দেয়, তাদের ছেড়ে ইউরোপ ট্রিপ করে আসাতে। তাকেই এই ভ্রমনে অংশগ্রহণে সুযোগ দেওয়া হউক। আমাদের বাচ্চাটা সবে মাত্র ২ বছর শেষ করে ৩ বছরে পাড়া দিয়েছে।




কি পরিমান দুষ্ট, আমার কাছে ভাষা নাই লিখে বোঝানোর। আমার বাপ-মা যে পরিমান প্রহার করেনি আমায়, সম্ভবত সুযোগ পাইলে সে সেটাই করে। অতি আদরের বলে বেশি কিছু করতে পারিনা। মিনটু স্যা, মাইর দিতে পারিনা যাতে সে ব্যাথা পায়। তাছাড়া সে খুব বেশি মাত্রায় মেজাজি হওয়াতে আমরা নিজেদের আচরণে একটু পরিবর্তন এনেছি। এখন ব্যাপার হল তাকে নিয়ে ইস্তামবুল সফর, আমার বৌয়ের জন্য ঈদের চাঁদ দেখা আর রমজানের রোজায় বাজার করার সমান আনন্দের হলেও, আমার জন্য ছিল খালি পায়ে পাথরের উপর চলার মত মহা কষ্টের। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যেই জেগে গেছি ভয়ে, এই মেয়ে আমায় কি পরিমাণ দৌড়ের উপর রাখবে, বেড়াইতে গেলে?


আমার টিকেট হাতে পাওয়ার পর, এক রাত্রে হঠাৎ করেই তাদের দু’জনের (বৌ-মেয়ে) টিকেট কিনে ফেললাম অন-লাইনে। তারপর বৌ’রে জানান দিলাম, তুমি এবার রেডি হইতে পার একবার ইস্তাম্বুল ভ্রমণের জন্য।


এবারই সে প্রথম দেশের বাইরে যাবে তা নয়, সে আছেই দেশের বাইরে, তাই বাজার সদায় করতে তার মানা ছিলনা প্রথম থেকেই। কিন্তু তাতে নতুন মাত্রা পেল ইস্তামবুল সফরে যাবার পরিকল্পনা। ২ মাস আগে থেকে নতুন কাপড়, জুতা আর কতকি ব্যবস্থাপনা শুরু করে দিয়েছিল। আমার কাজছিল কাজের ব্যাটা কাছিম মত ব্যাগ গুছানো।


জানুয়ারী মাসের দেখা পেতে অপেক্ষায় করছিলাম। ভিসা প্রয়োজন তুর্কির, তবেই তারা তাদের দেশে আমাদের ঘোরার অনুমুতি দিবেন। অফিসে বস্‌-কে বলিলাম। গ্রীন সিগনেল পেয়ে ভিসার জন্য অফিস কামাই করলাম দু’দিন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে। প্রতিটি ভিসাতে ২৫০ দেরহাম মোট ৭৫০ দেরহাম মুচলেকা প্রদাণ পূর্বক ভিসা হস্তগত হয়েছে। সাথে আন্তজার্তীক ট্রাভেল ইন্সুরেন্স ২০০ দেরহাম ৩ জনের জন্য। আমি অনলাইনে এপ্লিকেশণ পুরণ করলেও তারা নতুন করে পুরণ করতে বাধ্য করল যে টাইপিং সেন্টারে তাদের পোর্টল রেজিষ্টেশন আছে সেই সেন্টার থেকে। সেখানে ৩০০ দেরহাম, পার্কি ফি দিয়েছি প্রায় ১৫০ দেরহাম। দুবাই ডিআইএফসিতে পার্কিং পাওয়া কষ্ট কর, আর ভ্যালট পার্কিং মানেইতো ভিআইপ চার্জ।


ভিসা পেতে বেগ পাইনি, তবে পরিবার নিয়ে যেতে হয়েছিল, উপস্থিতি বোঝানোর জন্য। ভিসা এপ্লাই করার ৩ দিনের মধ্যে দিয়ে দেয়, গিয়ে নিয়ে আসতে হয় কনসোলট থেকে। এই পর্যন্ত সবটাই ভাল যাচ্ছে। হোটেল ডট কম থেকে নিজের পছন্দমত হোটেলও বুর্কিং করে রাখলাম।


যাওয়া কয়েকদিন আগে থেকে গোছানো শুরু। আমাদের ফ্লাইট ছিল ১১ ফেব্রুয়ারী সকাল ৭টায়। খুব ভোরে ফারুক আমাদের এয়াপোর্টে ছেড়ে দেয়। সেদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে ৪:৩০ মিনিটে। লিমা ঘুম থেকে জেগেই আরেকবার সবকিছু দেখছিল, কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা। সাথে সকালের খাবার বানাচ্ছিল। অক্টিভিয়া লেয়া, মানে আমার মেয়েকে জাগালাম। বল্লাম মা, চল আমরা টা-টা যাবো।


বাস্‌ সে একবার আমার দিকে তাকালো, তারপর উঠেই বসল। শুরু করল নিজ থেকে তার কাপড় খোলা, ও তার মাকে অর্ডার করল নতুন কাপড় দিতে (ডেস- ড্রেস, দুতু -জুতু)। একবার এও জানালো পাম্পাস খুলে দিতে (পাঙ্কস-পাম্পাস)। দেখছিলাম সে খুব আনন্দিত, কোথায় যাচ্ছে যে নিজেও জানে না। তবে আমার উদ্দেশ্যে বুঝেই নিজেকে তৈরীতে ব্যস্ত। সকাল সকাল একচোট হাসার সুযোগ হল।


আমরা সবাই লেয়ার চিচিকে বিদায় দিয়ে টার্মিনাল ওয়ান দুবাই এয়াপোর্টে প্রবেশ করলাম। ওহ্‌ লেয়ার ভাল বন্ধু চিচি এবং বাবু (ফারুক চাচা কে চিচি ডাকে, আর পাবেলকে বাবু)। আমি অনলাইনে আগে থেকেই বোর্ডিং করিয়ে রেখেছিলাম। দুটো টিকেটের পিএনআর নাম্বার আলাদা থাকাতে বুঝেছিলাম এয়াপোর্টে হয়ত একসাথে বসার সুযোগ নাও পেতে পারি। আমাদের যাত্রা শুরু করলাম পৌঁছালাম ঘন্টাখানেক পড়েই দোহা, কাতার এয়ারপোর্টে।


অপেক্ষা করছিলাম কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্য, ৩০ মিনিট হাতে সময় ছিল। মনে পড়ল দোহাতে এক পরিচিত ছোট ভাই থাকে। তাকে একটু নক করা যাক সকাল সকাল। দোহাতে তখন বাজে ৮টা, নাম ছিল লেলিন রামুতে তাদের বাড়ি। আমার নামের সাথে তার নামের দূরত্ব শুধু একটা “ন”। আমি লেনিন, আরও লেলিন। জানালাম আমি দোহা এয়ারপোর্টে, তার সাথে কথা বলতে চাই, ওর নাম্বার প্রয়োজন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে নাম্বার দিল। আমি ইন্টারনেশ্যাল রোমিং-এ ছিলাম। কথা হলো কয়েক মিনিট। পানির ভিষণ পিপাসা পেয়েছে। ষ্টারবাস্ক থেকে পিপাসা মিটালাম সপরিবারে।


ডাকপড়ল উঠে পড়ার, একটু পড়েই কানেক্টিং ফ্লাইটি ছেড়ে যাবে। চেপে বসলাম, তুর্কি যাত্রায় উড়োজাহাজে।


দুপুর একটা নাগাদ ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। আমার সব লাগেজ ঠিক মত এসেছে, শুধু মাত্র ট্রলিটি ছাড়া, যেটাতে লেয়াকে বসানো হবে। ওর মাকে বললাম তুমি ওকে দেখে রাখ, আমি দেখছি কাষ্টমার কেয়ারে কথা বলে। লেয়া সেই সুযোগে ভৌ-দৌঁড় শুরু করলো। এয়ারপোর্টের মোটামুটি ব্যাগেজ এরিয়াতে যারা ছিল তাদের সবাইকে হাই হ্যালো, ফ্লাইং কিস দিতে দিতে তার সময় পাড় করছিল। আর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ওর মাকে দৌড়াছিল। আমি ফিরে আসতেই দেখলাম আমার বৌ’য়ের চেহেরা লাল, লজ্জায় নয়, দুঃখে। আমাদের সবার একটু শরীর খারপ লাগছে, খুব ভোরে উঠার অভ্যাস কারো নেই বললে চলে, নেহাইত কোন প্রয়োজন ছাড়া। যেটা আমাদের পেয়ে বসেছে।


ট্রলিটি সংগ্রহ করে ওকে বসালাম। এক বাঙ্গালী আমাদের সাথে এসে পরিচিত হল। জানালো সে ব্রাজিল থেকে ঘুরে আসছে। আমরা কোথায় যাব সেটা তার জানায় উদ্দেশ্য। জানালাম তাকসিম স্কয়ার যাব। সে কোন হোটেল বুকিং করেনি। আমাদের সহযোগীতা চাইছিল; যেন তাকে সাথে তাকসিম পর্যন্ত নিয়ে যায়।


এয়ার পোর্টের বাইরের এসেই টেক্সি ষ্টেন্ড থেকে একটি টেক্সি ভাড়া করলাম। কেন জানি আমি বিরক্ত বোধ করছিলাম, মুখ দিয়ে ঠিক মত কথা বের হচ্ছিলনা। তার উপর ড্রাইভার ছিল বুড়ো, এবং ইংরেজী ভাঙ্গা ভাঙ্গা বলছিল। সাথে বাঙ্গালী সঙ্গিকে নিয়ে তাকসিমের পৌঁছালাম, টেক্সি ভাড়া ৬০ লিরা পরিশোধ করে হোটেলে উঠলাম। সেখানে বাঙ্গালী আগন্তুকে বিদায় দিলাম।


এখন একটু জিরিয়ে নেওয়ার পালা। গোসল করলাম গরম পানিতে, হোটেল রুমটা নিজের মত গুছিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে কাটালাম। মাথা ঝিম ঝিম করছিল, তাই ব্যাথা নাশক ঔষধ নিলাম আমরা দু’জনেই। দুপুরের খাবার এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ দিল, তাই অতিরিক্ত খাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। লিমাকে বললাম চল একটু ঘুরে আসি। বাইরে খুব ঠান্ডা ৭ ডিগ্রির কাছাকাছি হিমাঙ্ক। লেয়াকে ট্রলিতে বসিয়ে হাঁটা শুরু করলাম রাস্তার পাশের গলিগুলোতে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস খুবই মজা পাচ্ছিলাম। বাইরে খেলাম, ফেরত আসলাম ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই।


লেয়া খুব মজা নিচ্ছিল, সে অনব্রত কথা বলছিল। যদিও আমরা এখনো তার কথা বুঝিনা সবটা। নতুন নতুন মুখ দেখলে হাই হ্যাল করছিল। এখানে আমি ঘুরে মজা করতে আসিনি। এসেছি পরিবারকে সময় দিতে।


দুবাইতে সকাল ৮টায় অফিসের উদ্দেশ্যে বার হই, বাসাই ফিরি ৫-৬ টার দিকে ট্রাফিক ঠেলে। বাসায় পৌঁছে মেয়ে’কে খুব যে বেশি সময় দিতে পারি তা কিন্তু নয়। অনেক কাজ জমানো থাকে। ফারুকের আসার অপেক্ষা থাকে, কিছু চায়ে বিস্কিটের গুড়ে গুলিয়ে আবার কাজে লেগে পড়ি। কাজ বলতে, অনেক কথা হয়, পরিকল্পনা হয়, ঝাঁড় পোঁক হয়। তবে আইডিয়ার, একটা ভার্চুয়েল রিয়েলিটি সো তৈরী হয়। এটা ওটা অনেকটা কিছু। ফারুক ঘন্টা ২ বসে চলে যায় নামাজে। আমি আবার নিজের কাজে মগ্ন হই। রাতের খাবার খেতে ডাক পড়ে বৌ’য়ের খেয়ে আবার কম্পিউটারের সামনে কি যে করি? তার কোন উত্তর নেই। তবে অনেক কিছু হয়; যা হয়ত আজকের জন্য নয়, তবে ভবিষ্যত কাজের প্রস্তুতি।


পরের দিন সকাল ৮.৩০মিনিটে ঘুম ভাঙ্গাল, আজ শুক্রবার। দিনটা একটু বেশি মেঘলা।, বৃষ্টি হবে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ইন্টারনেট এ জেনে নিয়েছি। সবাইকে উঠালাম। নিচে আসলাম কম্পিমেন্টারী সকালের নাস্তা গ্রহণের জন্য। ইংলিশ ব্রেকফাষ্ট ছিল, সাধারণত আমাদের মত মানুষের এসব পছন্দ হওয়ার কথা নয়। আমার খুব একটা ভারাপ লাগছিলনা, অনেকটা অভ্যস্ত ছিলাম। আমার বৌয়ের চেহেরা দেখার মত ছিল। অতি অসহায়ের মত খাচ্ছিল। সব খাবার দিলেও আমাদের স্বাধ অনুযায়ী নয়। তাই কোন প্রকার খাবার শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম। আজ কোথায় ঘোরাঘুরির উদ্দেশ্যে বের হয়নি। তবে মাথাই ছিল তাকসিম স্কায়ারের দিকে যাব। ঝকঝকে একটি দিন শুরু করলাম। অনেকগুলো কবুতর এই দিক থেকে ঐ দিকে ডানা ঝাপটিয়ে বেড়াচ্ছিল। কেউ কেউ খাবার দিচ্ছে ১-২ লিরাতে কেনা খাবারের পেয়ালা। এখানে আসার পর অনুভুত হল কি পরিমান সিরিয়ান জনগন ভিক্ষা বৃত্তিতে আছে।


আমরাও কিছু সময় কাটালাম কবুতরকে খাবার দিয়ে তাকসিম স্কয়ারে। ব্লু মস্কের কথা অনেক শুনেছি, এখন উদ্দেশ্য ঐ দিকটায় যাওয়া। একটি হলুদ ক্যাব ভাড়া করলাম ৩০ লিরাতে (১০-১৫ লিরা অতিরিক্ত নিল টেক্সি চালক)। ২০ মিনিটের মধ্যেই ব্লু মস্কের সামনে ছেড়ে দিল। কারো বদনাম করার উদ্দেশ্য বলছিনা, ইস্তাম্বুলে একটি জীনিস অপছন্দের বলতে গেলে এই টেক্সি চালকগুলো সেই পরিমাণ বদের বদ। প্রথম কথা তারা সোজা রাস্তায় আপনাকে নিবেনা যদি বুঝে আপনি বেড়াতে এসেছেন, দ্বীতিয়ত এমন ভাব করবে কিছুই বুঝে নায়। যদি বুঝেও থাকে তা আপনাকে বুঝাবে বাজে চাহনি এবং তার বক্তব্য দিয়ে। বাষ্টার্ড।


ব্লু মস্কে ঢুকার পর মেয়েটা আর ট্রলিতে বসবেনা বলে প্রতিবাদ শুরু করে দিল। সকাল বেলা ঠিক মত নাস্তা করেনি, সম্ভবত পায়খানাও করেনি ঠিকমত। তাই চেঁচামেচি করছিল। ওকে ট্রলি থেকে নামানোতে সে যে দৌঁড় শুরু করল, তাতে তাকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাব কিনা সেই ভয় মনে উঁকি দিচ্ছিল। বউকে মসজিদের বাইরে রেখে ভেতরে গেলাম, দেখতে। তখন যুম্মার আযান দিচ্ছে, আজ শুক্রবার। ভেতরে সারি সারি মানুষ, একটা জিনিস ব্যতিক্রম, যে যার যার সাথেই তাদের জুতো জোড়া রেখেছে। হাজার হাজার মানুষ ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। কোন ধরণে প্রতিবন্ধকতা নায়। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রিষ্টান কোন বাঁধা নায়। ঢুকছে মসজিদে, দেখে বের হয়ে যাচ্ছে আপন মনে।


মসজিদ থেকে বের হলে রাস্তার পাশে ছোলা আর বাদাম নিলাম, হালকা নাস্তাও করে নিলাম। লিয়া নুডলস খাবে, এখানে ভাত পাওয়ার কোন সুযোগ দেখছিলাম না। আমার একটা সীমও নেওয়ার দরকার ইন্টার নেট চালু করার জন্য। রোমীয়ে অনেক বেশি টাকা চার্জ করে। লিমা এবং লিয়া এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর ২টা দোকান পেলাম, কিন্তু দাম হাঁকাচ্ছিল ভুতুড়ে, তাই ফিরে আসলাম হাতে একটা ছোট পেকেটে নুডলস আর কাষ্টারর্ড নিয়ে। কাষ্টার্ড হাতে নিয়ে এক পুরানো বান্ধবীকে মনে পড়ে গেল।


আমি যদি ভুল না করি, জীবনে প্রথম কাষ্টার্ড খেয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। হ্যাঁ অনেকেই চেনে আমার ঐ বান্ধবীকে “রফ রফ”। কি একটা কারণে ওদের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়। আমি খুব তাড়াঁতে ছিলাম, ফ্রিজে হাতের কাছে ঐ কাষ্টাডই পড়ে ছিল। আমি অবশ্য আমার বৌকে ওর স্মৃতি চারণ করছিলাম।


লিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রলির মধ্যে। আমার বৌ রেগে আছে, তাদের ছেড়ে ২০-২৫ মিনিট কোথাই ছিলাম? লিয়াকে জোর করে তুলে খাবার খাওয়ালাম। খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আমরা হাঁটা শুরু করলাম, পেটে এখনো খিদে আসেনি। চলতে চলতে গ্রান্ড বাজারে ঢুকে গেলাম, গ্রান্ড বাজারে যাওয়ার আগে রাস্তায় আমাদের বৃষ্টি পেয়ে বসল। প্রায় ঘন্টা খানিক বৃষ্টি ছিল। বিভিন্ন দোকানের ভেতর আশ্রয় নিলাম।


গ্রান্ড বাজারটা অনেক সুন্দর, পুরোনো সব দোকান। অনেক কিছুই আছেই কেনার, টুরিষ্ট এরিয়া বলে অনেক বেশি দাম চাচ্ছিল। পুরো গ্রান্ড বাজারটা চক্কর দিয়ে বসলাম একটা খাবার দোকানে। খেলাম তাদের স্থা্নীয় খাবার, হ্যাঁ অবশ্যই কাবাব। গ্রান্ড বাজার থেকে বের হতেই আবার বৃষ্টি, মাঝে মাঝে থামছিলাম দোকানগুলোতে। খাঁড়া উপর থেকে নিচে, কম পক্ষে ২৫ তলা পর্যন্ত, ১২৫ মিটার সরু রাস্তা নিচের দিকে আসতেই চোখে পড়ল গালাটা ব্রীজ। জায়গাটা চমৎকার দেখতে। মনে হচ্ছিল ২টা দেশকে একটি ব্রীজ সংযুক্ত করেছে।


আবার বৃষ্টি শুরু, আমরা খুব তাড়াতাড়ি ব্রীজের নিচে রাস্তা পার হওয়ার জায়গা কিছুক্ষণ আশ্রয় নিলাম। সেখান থেকেই চোখে পড়ল ব্রীজের নিচে অনেকগুলো রেস্তোঁরা। বেছে বেছে একটা রেস্তোঁরাতে ঢুকলাম, এখানে একটু ভীড় কম। তাজা মাছের একটি ম্যানু নিয়ে আসল। কিছু খাবার অর্ডার দিলাম, সাথে বিয়ার এবং তার্কিস কফি। খুব ঠান্ডা পড়ছিল, প্রচুর কাপড় পড়ে বের হলেও রীতমত কাঁপছিলাম।


খাবার শেষ করে ব্রীজের নিচের রাস্তা ধরে ফিরছিলাম তাকসিমের দিকে। আমাদের হোটেল থেকে তাকসিমের দূরত্ব ১ মাইলের মত। আমরা যেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম হোটেল উদ্দেশ্যে সেখান থেকে তাকসিমের দূরত্ব ১.৫ মাইল। ভাবলাম হাটতে হাটতে পৌঁছে যাব। রাস্তার লোকদের জিজ্ঞাসা করে করে পথ চলছিলাম যেন ভুল না করি। হঠাৎ একটা রাস্তার সামনে এসে বুঝতে পাড়লাম আমাদের উপরের দিকে উঠতে হবে। মনে হচ্ছিল এইতো মাত্র ২-৩ মিনিট উঠলেই সমতল কিছু একটা থাকবে। জানতাম না এই রাস্তাটা সোজা উঠেগেলে তাকসিম। কোথাও জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ ছিলনা। চলছি তো চলছি প্রায় ৫০-৫৫ মিনিট পর আমাদের চলা শেষ হল। হয়তো ১ মাইল মত উপরের দিকে উঠছিলাম। একা উঠতেই কলিজা বের হয়ে যাচ্ছিল, তার মধ্যে বাচ্চার ট্রলি নিয়ে উপরে উঠা সেতো মহা সাগর পাড়ি দেওয়ার মত ব্যাপার। কেউ যদি আমাদের আগে থেকে বলে দিত হয়তো এই রাস্তা দিয়ে জীবনেও আসতামনা। চ্যালেঞ্জটা না জানাতে অন্ধকারে পথ হাতড়ে উঠার মত আমাদের প্রথম গন্তব্য পৌঁছালাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা দু’জনেই ভিজে গেছি। লেয়া যেন না ভিজে সেই জন্য, যে পরিমান ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল সবটুকু নেওয়া হয়েছিল। ভাগ্গিস মেয়েটা কোন প্রকার চুপ করেছিল, বিরক্ত করেনি। হয়তো আমাদের সমস্যা বুঝতে পারছিল।


তাকসিম থেকে আরো ১ মাইল হাটতে হবে। এখন ভাল লাগছে, অনেকগুলো রেস্তোঁরার সামনে দিয়ে চলছিলাম। খাবারের ম্যানু পছন্দ হচ্ছেনা। সারাদিন এত কষ্টের পর স্বাভাবিক ভাবেই মন থেকে শুধু ভাত নামক শব্দটি বের হচ্ছে। ইস্তাম্বুল এমন একটি জায়গা যেখানে শুধু কাবাবই বিক্রি হয় শতকরা ৯৫%। ৫% খুঁজে বের করা কষ্ট সাধ্য অন্যান্য খাবারের তালিকা থেকে।


খাবার খেলাম, একটা গ্রোসারিতে ঢুকেই হালকা বাজার করলাম। বিস্কিট, পানি, রুটি, চকলেট, রাত্রে মেয়েটা খাবে তাই আরেকটা কার্ষ্টাড নিয়ে রাখলাম। বাসায় ফিরে সবাই স্নানাগারে দৌঁড়। সারাদিন এক প্রকার কোন কর্মই সম্পাদিত হয়নি। স্নান সারলাম, পা সাংঘাতিক রকমের ব্যাথা। ঔষধ নিলাম এবং ঐ দিনের ছবিগুলো ফেইসবুকে দিলাম। চিচি আর বাবু আমাদের খবর নেওয়ার চেষ্ঠা করছিলেন, কিন্তু সারাদিন নেট সংযোগের বাইরে থাকায় তাদের কোন খবর দিতে পারিনি।


এখন ঘুমানোর পালা। অনেক ক্লান্ত, যা ভাষায় বোঝানোর সুযোগ নেই।


দ্বীতিয় দিন তীব্র ব্যাথা নিয়ে ঘুম থেকে জাগলাম। পিঠে ব্যাথা হচ্ছিল, আমার এমনিতেই একটা ব্যাথা আছে, এই ব্যাথাটাকে বাত নামে যানি। শোয়া থেকে উঠে নিচে নামতেই বুঝতে পারলাম পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যাথা হয়ে গেছে। দিনটা মেঘলা, তবে বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছেনা। সকাল ৯টায় নাস্তা করতে গেলাম।, মেয়েটা তেমন কিছুই খাচ্ছে না। তাই নাস্তা করতে গিয়ে আলাদা প্লেটে পাউরুটি, সুপ আর ডিম সেদ্ধ নিয়ে আসলাম। তারপর মাইরের ভয় দেখায়ে খাওয়ালাম। এই দুইদিন বাচ্চার ওজন অনেকটা কম মনে হচ্ছিল, যদিও সে সুস্থ আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ বেশির ভাগ সময় হোটেলে কাটাব। শনিবার, তাই অফিস থেকে তেমন বেশি কোন বেগতিক ফোন কল আসে নায়।


বিকেলে বের হলাম, হাটতে হাটতে একটা মোবাইল ফোনের দোকান থেকে সীম কিনলাম। তা একটিভ করলাম ইন্টারনেট নেওয়ার জন্য। গেলাম একটা রেস্তোরাতে, খেলাম হালকা। প্রায় আজও ২ মাইলের মত হাটলাম, একটা বড় শপিং মল সামনে পড়ল ঢুকে গেলাম। অনেকটা দুবাইয়ের মলের মত। তবে অনেক বেশি নিরাপত্তা। মলে ঢুকতে গেলে কয়েক দফায় ব্যাগ আর ট্রলি চেক করছিল। দুবাইতে এই ধরণের কোন সমস্যা নায়। কোন আলাদা নিরাপত্তা ঠেলে যেতে হয়না।


শপিং মল থেকে বের হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম জুরাসি ল্যান্ডে যাব। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, ৪-৫ মাইলের মধ্যে জায়গাটা মল থেকে দূরত্বে। একটা টেক্সি ক্যাব ভাড়া করলাম। তারা ৬০ লিরা ভাড়া চাইল, মূলত এর ভাড়া ২০-৩০ লিরার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। আমার শর্ত ছিল ঐ টাকাটা দিব, যে টাকাটা মিটারে আসে। ড্রাইভার রাজী হল, আমাদের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে বসার সাথে সাথে আরেকজন অতিরিক্ত ড্রাইভার বসল সামনের সীটে। বুঝালো তাদের ডিউটি টাইম চেঞ্চ হচ্ছে তাই অন্য ড্রাইভারকে রাস্তায় নামিয়ে দিবে।


দুবাইতে এই রীতিটা আছে, তবে সব সময় নায়। কখনো কখনো হয়, যখন পেসেঞ্জার থাকেনা। আমি ভেবে নিলাম এখানের নিয়ম হয়ত এরকমই হবে। গাড়ি ষ্টাট দিয়ে ড্রাইভার ৬০ লিরা চাইল। আমি দিতে অস্বীকৃতি জানালাম। জানতে চাইলাম এরকম কোন নিয়ম নেই তুমি আমাদের পৌঁছে না দেওয়ার আগে তোমায় লিরা দিব, তাছাড়া আমি তোমাদের টাকা দিব মিটারে বিল যত আসবে। আমরা শেষ পর্যন্ত বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে নেমে গেলাম টেক্সি থেকে। বুঝলাম তুর্কিতে ট্রেকি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া মানে নিজের বিপদ ডাকা ছাড়া আর কিছুই নয়।


মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আর কোথাও যাওয়ার অভিপ্রায় ছিলনা এই পরিস্থিতির পর। বউরে বললাম চল, হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে চলে যায়, আজ আর কোথায় যাব না। রেষ্ট নিব। হোটেলে ফিরে গেলাম, মেয়েকে বেশ কিছু সময় দিলাম। রাত্রে খেতে বের হলাম, আজ ভাত খাইতেই হবে। আর কাবাব সহ্য হচ্ছে না। হোটেলে পাশেই একটা বড় রেস্তোঁরা ছিল, সেখানে তাদের মত করে রান্না করা ভাত মাছ খেলাম। যদিও তৃপ্তি পাইনি। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল এই আর কি! বাসায় ফিরে ঘুম দিলাম।


পরের দিন ঘুম ভাঙ্গল, নাস্তা করলাম যথারীতি।


আনফরচুনেটলি দিনটি ভেলেনটাইন ডে। ভাবিনি এই দিনটি তুর্কিতে কাটাবো। রোমান্টিকতার অর্থে আমার উপস্থিতি দেখানো বা জানানোর মত কোন বড় বিষয় ছিলনা। দিনটা এই ইস্তাম্বুলে পড়াতে ভাবলাম দিনটাকে একটু রোমান্টিকতার রংয়ে রাঙ্গাব। হোটেল থেকে প্রায় ১১টার দিকে বার হলাম। মেয়েটা আজ রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়ল। হাটতে হাটতে তাকসিম স্কয়ারের দিকে গেলাম। কিছু বাজার করলাম, ঠান্ডার কাপড়। তাকসিমে পৌঁছাতেই দেখলাম নতুন একটি বেলুন বার লাভ চিহ্নিত সাজানো আছে। সবাই গিয়ে ছবি তুলছে। বৌ’কে মাথায় ফুলের মালা কিনে দিলাম, তারপর লাইনে দাড়াঁয়ে ছবি তুললাম।


আজ ট্যুর বাসের টিকেট নিলাম, সিটি ট্যুর। ইস্তাম্বুল সিটিতে প্রয়োজনীয় এবং দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরে দেখার সহজ উপায়। বাস, ট্রাম আর মেট্রো রেল চলাফেরার জন্য নিরাপদও বটে। শুধুমাত্র টেক্সি ছাড়া।


বাসের দুটা লাইন আছে। ব্লু এবং রেড। দুটি লাইন শহরের মধ্যে থেকেই শুরু এবং দুদিকে চলে গেছে দু’পথে। আজকের প্ল্যান রেড লাইনে থাকা দর্শণীয় স্থানগুলোতে যাওয়া। বাসের উপরের অংশে বেশ জায়গা ছিল। ট্রলিটি ভেতরে রাখার ব্যবস্থা ছিল। আমরা সবাই উপর থেকে ইস্তাম্বুল শহরটাকে দেখছিলাম। সুন্দর, সাজানো গোছানো, বোঝার সুযোগ নেই এই দেশটার পার্শ্বের দেশটিতে যুদ্ধ চলছে। মানুষ মরছে। এখানে এক অদ্ভুদ নিরবতা, যে যার যার মত চলছে, ফিরছে, হাসছে। একটা জীনিস আমায় মহিত করেছে এই দেশটার। এত ঘন বসতি এবং মানুষ অভাবের মধ্যেও আছে কিন্তু সব জায়গায় পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। কোথাও কোন অসামঞ্চস্যাতা ছিলনা। পরিবেশ দুষণ ছিলনা।


ডালমাবার্চ প্যালেস এর সামনে ষ্টেশনে নামলাম। টিকেট কিনে ঢুকলাম। বিশাল প্রাসাদ, প্রাসাদের ভেতরের চেয়ে বাইরের পরিবেশটাকে আমার বেশি ভাল লেগেছে। সমুদ্রের পানি প্যালেসের বাউন্ডারীর উপর উপচে পড়ছিল। প্রায় ৫টা বিশাল ফ্রেম দিয়ে প্রাসাদের দেয়াল ঘেরা আছে। কেউ ঐ ফ্রেমের মধ্যে দাড়িয়ে ছবি তুললে মনে হবে পানি উপর ফ্রেম এর মাঝ খানে কেউ দাড়িয়ে আছে। ঘন্টা ৩-৪ পার করে বাস ষ্টেশনে এসে দাড়াঁলাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে টুরিষ্ট বাসের দেখা পেলাম।


ফিরলাম ইজেপসিয়াম স্কয়ারে। সেখান থেকে জাহাজে ১২ লিরা প্রতিজনে উঠে বসলাম। ঠান্ডা আবহাওয়া। আজ অন্যদিনের চেয়ে ঘুরতে আসা অতিথিদের চাপ বেশি। ভেলেন্টাইন ডে উপলক্ষে জোড়া জোড়া নব্য প্রজাপতির ঘোরাঘুরি। ফ্রেন্স কালচারের ছোঁয়া থাকায় বেশির ভাগ ছেলে মেয়ের উন্মক্তোতা বেশি ছিল; যা হয়ত সামান্য হলেও চোখে দৃষ্টি কটু লেগেছে। লেগোচি বলে কথা, আমি অভ্যস্ত নয় হয়তো, তাই গ্রহণযোগ্যতার বিচার থেকে বলাটা অন্যায় হবে। প্রায় ১.৪৫ মিনিট জাহাজে পুরো ইস্তামবুল কে পরিদর্শণ করলাম। অসম্ভব সুন্দর দুপাশের শহর, এশিয়ান আর ইউরোপীয়ান সভ্যতার শহর। প্রায় ৩০ মিনিট চলার পর প্রচন্ড বাতাসে জাহাজের উপরের কেবিনের সবাইকে শরীর কাপিয়ে নিচ্ছিল। আমি আমার বৌ-বাচ্চাকে নিচের কেবিনে পাঠিয়ে দিলাম। একটু একা থাকতে ইচ্ছা করছে। ঠান্ডা, প্রচন্ড ঠান্ডা, সুয়েটার যথেষ্ঠ ছিলনা এই ঠান্ডার বিরুদ্ধে। একটু দুরত্বে চোখ পড়তে দেখছিলাম বেশ কিছু অশালিন কম বয়সি ছেলে মেয়ে। একটু অন্ধকার আর ঠান্ডার জেরে সুযোগ নিচ্ছিল, বের হচ্ছিল শালিনতার বাইরে।


আমাদের জাহাজ ভ্রমন শেষ, ফিরবো হোটেলে। তাকসিম স্কয়ারের কাছেই বাস থেকে নেমে মেট্রোতে চড়ে বসলাম, সিসলি ষ্টেশনে এসে নামলাম, তার একটু কাছেই আমাদের হোটেল। আজকের দিনটা অন্য দিনগুলোর চেয়ে অনেক ভালাই কেটেছে। কাল আরেকটা দিন ঘুরার সুযোগ হবে। এরপর ব্যাগ গুছানোর শুরু করতে হবে।


আমি একটু এমনিতেই হাফিয়ে উঠছিলাম, আরামদায়ক ছিলনা এই ট্রিপটি। সিদ্ধান্ত নিলাম যা কিছু ঘোরার বাকি ছিল তা কাল সকাল সকাল বেরিয়ে শেষ করতে হবে।


১৫ ফেব্রুয়ারী, সকাল থেকে ইমেইল, ফোন আসতে শুরু করল। একটু মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। সব কিছু আমি প্ল্যান করে করলেও আমার টিমে যারা আছে তাদের এই অভ্যাসটি রপ্ত করানোর অবান্তর চেষ্ঠা করে ব্যতিত হয়েছি হাজার বার। আজকেও তাই, এই ছুটিটি ৩-৫ মাস আগে প্লেন করার সময়, সমস্ত কলিগকে বলা হয়েছিল নিজের ছুটির সময় নির্ধারণ করতে। একই সময় একের বেশি অফিসার, ম্যানেজার যেন ছুটি না কাটায়।


আমি ছুটিতে যাওয়ার একদিন পর আমার কলিক ডারেন ছুটিতে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলছিল, কোন সমস্যা হবে না, আমি মেইলে জবাব দিব। কিন্তু বাস্তবতা তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। বেলজিয়ামের কোন একটি শহরে স্নো ক্সাই রাইডস করছিল। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেইলের জবাব দিয়েই নাস্তা শেষ করলাম। মেয়েটাকে রেডি করলাম এবং শর্ব শেষ বের হলাম।


মেট্রোতে তাকসিম স্কয়ারে গেলাম, সেখান থেকে রেড লাইনে ইজিপশান বাজারে আসলাম। বাস পরিবর্তণ করে ব্লু লাইনের বাসে চড়ে বসলাম। একটি ম্যাপ হাতে নিলাম, ১৫ মিনিট যেতেই হাতের ডানে বড় একটি গন্ডালার (নৌকার বহর) ফেরি দেখছিলাম। বাসটি তার কাছেই থামে যাত্রী উঠানোর জন্য, আমরা তাড়াতাড়ি নেমে পড়ি। হাতের বাম পার্শ্বে কেবল কার (তার পরিচালিত গাড়ি) নিচ থেকে উপরে উঠছে। ভাবলাম ওখানে যেতেই হবে। ভেতরে ঢুকলাম টিকেট নিলাম এবং সোজা উপরে উঠছিলাম। উঠার সময় মাটির দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারলাম হাজার হাজার কবর সুসজ্জিত সাজানো আছে। সম্ভববত লাখ লাখ কবর। কেবল কার থেকে পাহাড়ের চুড়ায় নামিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম, কবরগুলো দেখছিলাম। একটা কবর থেকে অন্য কবরটি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি কবরে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে। কবরের মাঝে, সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা, অক্টাভিয়ার (আমার মেয়ে) ট্রলিটি ঠেলে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল না। কবরের পাশ চলতে চলতে মনে হচ্ছিল, মরার জন্যও টাকার দরকার আছে। মৃত্যুর আগে অনেক টাকা রেখে যেতে হবে যাতে এত সুন্দর একটি কবর এখানে স্থাপন করা যায়। কবরের পাহাড় থেকে নিচের দৃশ্যগুলো মনরম। সাজানো গোছোনো শহর। ২-৩ ঘন্টা ছিলাম, তারপর নেমে এলাম।


নৌকা চড়ব, একটি সুন্দর সোনালী রংয়ের নৌকায় চড়ে বসলাম। ইলেট্রিক মেশিন চালিত। ১ ঘন্টা ঘুরে বুঝতে পারলাম এখানকার পাখিরা কতটুকু স্বাধীন। হাঁস, পাতিহাস, কবুতর তাও নানান প্রজাতির, কাঁকড়া। মাছ স্বচ্ছ পানিতে মাটির উপর খেলছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আবার রাস্তার পাশে এসে দাড়ালাম শেষ টুরিষ্ট বাসটি ধরব বলে। আধা ঘন্টা পর বাসটি এলো, চড়ে বসলাম। বেশি খানিকটা বেশি সময় লাগলো ইজিপশিয়ান বাজার ফিরতে।


এই জায়গাটি সম সময় অন্য রকম ব্যস্ত থাকে। আজও তাই, রমরমা মানুষজন। ইস্তাম্বুলের কয়েকটি টুরিষ্ট এরিয়ার মধ্যে এটি উন্নতম। কাল ফিরতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ফিরব বলে মেট্রো লাইনের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। ব্রীজটি প্রায় ১০ মিনিটের দুরুত্বে, সুন্দর ট্রেনের প্লাট ফর্ম। অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরলাম আমাদের হোটেলে।


ব্যাগ গুছানো শুরু করলাম। কিছু কাপড় বাড়তি হয়ে গেল। প্রায় সব কিছু গোছানোর পর রাত্রের খাবার খেলাম লোকাল ক্রজিনে, তার পর ঘুম। একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। ঘড়িতে ১৬ তারিখ, সকাল ৭টা ২০ মিনিট প্রায়। বৌ-বাচ্চাকে উঠালাম, নাস্তা করলাম হোটেলে। আমি একা বের হলাম। উদ্দেশ্যে একটি ব্যাগ কিনবো। যাতে মোটামুটি অতিরিক্ত কাপড়গুলো নেওয়া যায়।


হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছু কাপড়ের দোকানে ঢুকা হলো। একটা ছোট সাইজের ব্যাগ নিলাম। ইস্তাম্বুলে কাপড় অনেকটা সস্তা মনে হল, ডিজাইনগুলো মোটামুটি দেখার মত। একটা, দুইটা করতে করতে প্রায় ২২-২৪ টা কাপড় কিনে ফেললাম। এই প্রথম ইচ্ছামত ডানে বামে না ভেবে কিনলাম, এমনিতে আমি একটু চুজি, পছন্দ না হলে তেমন কাপড় কেনা পছন্দ নয়, তাও এক দোকান থেকে সর্বোচ্চ ২টার বেশি কেনা কাটা করি না। এই দোকনটার প্রায় প্রতিটি কাপড়ের ডিজাইন আর মান ছিল আমার পছন্দের।


হোটেলে ফিরলাম, রেডি হলাম। হোটেল ছাড়তে হবে নিয়ম অনুযায়ী ১২টায়, যদিও আমাদের ফ্লাইট ৪:৩০ মিনিটে। আমি যেখান থেকে হোটেল বুকিং করেছি, সেখানে আমার আলাদা ফেসিলিটি ছিল, আরলি চেক ইন এবং লেট চেক আউট। সুবিধাটা নিলাম। ২:৩০ মিনিটে বার হলাম হোটেল চেক আউট করে। একটি টেক্সিতে ফিরলাম এয়ার পোর্টে।


ইউরোপের অন্যান্য এয়ার পোর্টের মত গোছানো না হলেও, খুব একটা খারাপ বলা চলে না।


মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে আমাদের দু’জনেরই। সম্ভবত অতিরিক্ত খাটুনি আর আবহাওয়ার বদল শরীর নিতে পারছেনা। ষ্টারবক্স থেকে দুটি কফি আর ডেসপিরিন একসাথে নিলাম। কিছু ক্ষনের মধ্যেই লাইনে দাঁড়ালাম। ডাক পড়ল দুবাই ফেরার। কাল ৪টা মিটিং সকাল ১১টা থেকেই। বুঝতে পারছিলাম, দিনটি ছুটি নেওয়া থাকলেও, ছুটি কাটানোর সুযোগ নাই।


সকাল প্রায় ৪টায় দুবাই এয়ার পোর্ট এ পৌঁছালাম। চিচি (ফারুক) অপেক্ষা করছিল। বাসায় আসলাম, ঘন্টা ৩ ঘুমিয়ে আবার নিজেকে তৈরী করে অফিস। অদ্ভুদ ব্যস্ততা। আমি বিরক্ত নই... একটু ক্লান্ত।


ধন্যবাদ সবাইকে।

Featured Posts

Recent Posts

Archive

Search By Tags

Follow Me :

  • Blogger Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
  • Facebook Basic Square
bottom of page