top of page

France, Paris

৫ম অক্টোবর ২০১৫ - Switzerland –এ তৃতীয় এবং শেষ দিন, Paris, France – এ প্রথম দিন।



গতরাতেই রাতের খাবার টেবিলে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার জানিয়ে দিয়েছিল। “প্রিয় বন্ধুগন, সবার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আগামী কাল আমাদের ৭ ঘন্টার মত বাসের মধ্যে কাটাতে হবে। আমরা প্যারিস যাচ্ছি। সবাইকে যথাসময়ে সকালের নাস্তার টেবিলে হাজির হওয়ার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।” গত সব রাত্রের মত গতকালের রাত্রে খাবার টেবিলে হই হুল্লোড দেখলামনা। সবাই মাথা নিচু করে বলল “ইয়া”। আমি মনে করেছি আমার শরীর খারাপ বলে উত্তেজিনা দেখানোর মনমানষিকতা ছিলনা। কিন্তু বাকিদের অবস্থা দেখে মনে প্রশ্ন জাগল, কয়েকজনকে এক রকম জোর করে জিজ্ঞাসা করলাম, কি মন খারাপ? এই ভাবে উত্তর দিচ্ছ কেন? সবাই আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। শুধু মাত্র একজন কথাটার জবাব দিল। আমাদের খান ভাই। আজ খান ভাইকে নিয়ে লেখার শেষের দিকে কিছু কথা লিখব। অনেক ভাল একটা মানুষ।


ভোর ৫টায় খুম থেকে উঠলাম, আমি আজ আগে গোসলখানা দখল করলাম, কাপড় চোপড়গুলো এলোমেলো করা ছিল, গতরাত্রে গোছাইতে পারিনি। ধ্রুত গোসল সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। শরীরে একটু মাঞ্জা মারলাম, ইউরোপে আসার পর আমার গায়ের চামড়া যেন পাল্লাদিয়ে ফাটছে। নিজেকে গুছিয়ে নিচে এলাম। খাবার রুমে ঢুকেই খাবারের প্লেট সাজাতে শুরু করলাম, মাঝখানে লাগেজ ব্যাগটি ড্রাইভার ওয়াইনকে দিয়ে আসলাম। অন্যান্য সময় আমাকে নিয়ে সবাই মজা করে, আমাদের টিমে আমিই সম্ভবত খুব একটা বেশি কথা বলিনা প্রয়োজন ছাড়া। অনেকে মনে করে আমি ভাব নিছি অথবা অন্য কিছু। কেউ কেউ আমাকে বলে বিজি ম্যান। কি করব, অফিসের কিছু ফোন কলের জবাব দিতে হয়। সাথে সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। বয়সের ভাড়ে ঝুঁকে যাইনাই, তবে কর্মের ভারে চরিত্রটা একটা ডিফল্ট ফ্যাক্টরীতে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য চীল আওট করলেও আবার আগের জাইগায় ফিরে যায়। যেমনটি মোবাইল ফোনে ফেক্টরী ডিফল থাকে, রির্ষ্টাট দিলেই আগের অবস্থায় চলে যায় ঠিক তেমনি। সব সময় মনের ভিতর জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে, যেখানে নিজের মনের নিয়ন্ত্রণ ঐ ভাবনাগুলোর মধ্যে ডুবে যায়। আমি কাজ পাগল মানুষ, নিজের সম্পর্কে অত্তবড় একটা কথা বলা কতটুকু সমীচিন জানি না। তবে আমার সাথে যারা কাজ করে অথবা সাথে যারা জীবন যাপন করছে তাদের ধারণা আছে। কাজ পাগল বলতে কাজের ভারে নজু নই, আমার কাজ করতে ভাল লাগে। কাজের বাইরে থাকা পছন্দ করিনা। আমার বয়স যখন ১৫ তখন থেকেই জীবনে কাজের দুয়ার খুলে গেছে। কোননা কোন কারণে কিছু না কিছু করতেই হয়েছে জীবনকে চলমান রাখতে। আজ আমার বয়স ৩১ বছর। ১৭ বছরের অভ্যাস চাইলেই কি ১৫-২০ দিনে বদলানো যায়। আমার গত ১০ বছরের কর্ম জীবনে এক সাথে ২০ দিন ছুটি কখনোই কাটাই হয়নি, এই ছুটিটি ছিল জীবনের দীর্ঘ লম্বা একটা ছুটি। আমার বিয়েতে আমি ছুটি নিয়েছিলাম ১২ দিনের, বিয়ে করে নতুন বউকে নিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে হাজার মাইল, কর্ম জীবনকে সামাল দিতে।


নাস্তার টেবিলে সবার মন মড়া, আমারও কেন জানি মনটা ভাল নেই, কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা কারো সাথেই। নাস্তা শেষে বাসে উঠে বসলাম, কারলী বাসে মাইক হাতে বলতে শুরু করল, আজ আমাদের একসাথে থাকার শেষ দিন কারণ কেউ কেউ প্যারিসে থেকে যাবে, কেউ কেউ আমাদের সাথে লন্ডনে ফিরে যাবে। আমরা কেউ কাউকে চিনতামনা, জানতামনা, কিন্তু এতভাল একটা মানষিক বন্ধন কিভাবে তৈরী হল? বিরহ শব্দটার সাথে আমি বহুবার আলিঙ্গন করেছি, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না এইটাও একরকম বিরহ। হেই, আমি প্রেমের বিরহ বলছিনা, বি কেয়ার ফুল। অন্যাভাবে নেওয়ার সুযোগ নাই। হা হা হা। আমরা সবাই সবাইকে আরেক বার দেখতে লাগলাম, বেশ কয়বার একজন আরেক জনের সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল। সবাই সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলাম। বাস চলতে শুরু করল, কারলী কথা না বাড়িয়ে একটি ডিভিডি চালিয়ে দিল। কয়েকবার বাস থেমেছে, দুপুরের খাবার আর টয়লেট করার জন্য। মোটামুটি আজকের যাত্রায় কোন চিৎকার চেচামেচি দেখছিনা।


প্যারিস বর্ডার ক্রস করতে আবুকে ফোন দিলাম, ওকে জানালাম আমি প্যারিসে পৌঁছে গেছি। ওহ আবু কে? আবু আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু। সিটি কলেজে একসাথে পড়া লেখা করতাম। সে আমার চেয়ে সুজন, রাজ্জাক এদের বেশি কাছের বন্ধু ছিল। আমার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে ওর বড় ভাইয়ের জীমে। কক্সবাজার যারা আছে সবাই এডোনিস জীম চিনে থাকবেন। এইটাই ওদের জীম। ওর মেঝভাই আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন। আমি আমার এক জেঠুতত ভাই একসাথে জীমে ব্যায়াম করতে যেতাম। সে যেহেতু মাঝে মাঝে জীমে বসত সেহেতু কথা হত। সুজন রাজ্জাকের সাথে আমার সখ্যতা ছিল এবং পরে আবুর সাথেও ভাল একটা সম্পর্ক তৈরী হয়। মাঝে মাঝে ফেইস বুকে চ্যাট হত। কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পর সব ছেলে মেয়েই কর্মজীবনকে আপন করে নিয়েছে, পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। আমিতো সেই প্রথম থেকেই ঐ রাস্তায় হাটছিলাম, পুরানো পাপী। বন্ধু বলতে দু একজনের সাথে ভাল যোগাযোগ ছিল। বাকীদের সাথে যোগাযোগ সামর্থ্যে কুলাতো না। গত বছর আমার ইস্তাম্বুল যাওয়ার কথা ছিল, শরীফ ভাই (আমার আরেক বন্ধু, সহকর্মী ট্রান্সগ্রার্ড, দুবাই) এর সাথে ইস্তামবুল যাওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে যাওয়া হয়ে উঠেনি। সেই সময় আবুকে বলছিলাম আমি একবার আসতে পারি প্যারিসে। সেও খুব বন্ধুসুলভ অনুরোধ করল; তার সাথে যেন দু একটা দিন থেকে যাই। যখন ট্যুরটা বুক করছিলাম প্রথমে তাকে জানিয়েছি, কারণ সেও কাজ করে। আমি চাইনি তার কোন কাজে সমস্যা হোক। বন্ধু আমার এক কথায় বলে দিল; শুধু কোন দিন আসবি সেইটা বল। এত কথা বলার দরকার নাই, বুক করেনে।


প্যারিসে নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ২ দিন থাকার কথা। কিন্তু আমি থাকছি ৫ দিন। ২দিন আমার ট্যুর সদস্যদের সাথে আর ২-৩দিন আবুর সাথে। আবু ৩-২ দিন ছুটি নিয়েছে, আশা করি অনেক যায়গায় ঘুরা হবে, অনেক কথা শেয়ার করা হবে।


অফিস থেকে ফেইসবুকে বেশ কটি ম্যাসেজ আসা শুরু করে দিয়েছে। বিরক্ত লাগছিল, কাজের জন্য নয়, যাদের কাছ থেকে তথ্য আশা করছিলাম আমি ও আমার অফিসের কর্মকর্তারা তাদের উপর। এমনিতে মনটা ভার, তার উপর যোগাযোগ সফল করা যাচ্ছিলনা। এক পর্যায়ে সম্ভব হল যোক্তিক যোগাযোগের। আমরা প্যারিসে পৌঁছালাম বেলা ৪:১৫ মিনিটে। ঘন্টা খানেক হোটেলে বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার যাত্রা করলাম মূল শহরের দিকে।


প্যারিস সম্পর্কে ব্যবহারিক ধারনা দিতে হলে, এই শহরটা লন্ডনের মতই। ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ বছরে ট্যুরিট হিসাবে প্যারিসকে দেখতে আসে। প্যারেসকে ভালবাসার শহরও বলা হয়। এই শহরের রাস্তার চিত্র, বোর্ড, সাইন, মার্কিং কালার দুবাইর সাথে ৮০ ভাগ মিলে যায়। আরবরা প্যারস্য সংস্কৃতির ভক্ত সেটা জানতাম, কিন্তু প্যারিসের পুরো ব্রান্ডকে কপি করবে সেটা জানতামনা। দুবাইরের রাস্তাগুলো আরো অনেকগুন বড়, প্যারিসের গুলো ছোট এছাড়া বাকী সমস্ত রকম চিহ্ন প্রায় একই রকম। ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা আর ফ্রান্সের জনসংখ্যা প্রায় সমান। লন্ডনে ক্লক টাওয়ারে যাওয়ার পর প্রায় ১:৩০ ঘন্টা সাইকেল চালিয়ে রাস্তা গুলো দেখেছিলাম। আজ আমাদের বাসে করে প্যারীসের নদীর ঐ পাশটাকে দেখানো হল। হুবহু লন্ডন শহরের ডিজাইন মনে হল প্যারিসকে। লন্ডনের সাথে প্যারিসের স্থাপনাগুলোর যেমন মিল পাওয়া যায় তেমন মাঝখান থেকে বয়ে যাওয়া নদীটাও। এই দুটি শহরে ৪ দিন নয় ৪০ দিন থাকলেও এই শহরের পুরা কৃত্তিগুলো ঘুরে দেখা শেষ হবে না।


বাস এসে থামলো একটা জায়গায়, কারলী আমাদের তাকে অনুসরণ করতে বলল। ২৭২ সিড়ি বেয়ে আমরা কোন এক উপরের জায়গায় গিয়েছিলাম, নামটা মনে নেই, আসলে মনে রাখার চেষ্টা করিনি। সেখানে রেষ্টুরেন্ট এ বসে খেলাম, কিছু গ্রুপ ছবি উঠালাম শেষ বারের মত। এইবার আসি খান সাহেবে কথায়।


পুরা নাম মোহাম্মদ শহীদ খান, বাঙ্গালী, আমেরিকায় থাকেন পরিবার পরিজন নিয়ে, ব্যবসায়ী। ওনি আর ওনার শ্যালকের পরিবার নিয়ে আমাদের সাথে এই টুরে যোগ দিয়েছেন। ওনারা প্রায় ১০ সদস্যের টিম। প্রথম দেখাতে সবার মনে হতে পারে, লোকটার কোন বাতিক আছে। প্রচুর ছবি উঠাতে পারে। উনার মোবাইল ফোন, ডিএসএলআর (এডভান্স), ডিজিটাল ক্যামেরা সহ তিনটা যন্ত্র শুধু ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করেন এক সাথে। সাথে সেলফি তোলার স্টিক। সবাই প্রথমে কিভাবে নিয়েছিল সেটা আমি জানিনা, তবে কয়েকজন পাগল মনে করেছিল সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। আমি অন্যজগতের মানুষ, কে কি করল তাতে আমার কিছু আসে যায়না, সমালোচনা আমার সামনে করলে শুধু শুনে থাকি। সেই মানুষটা একে একে আমাদের সবার সাথে পরিচিত হয়েছে, একে অন্যকে পরিচিত হতে বাধ্য করেছেন। আমার ক্যামেরা থাকার পরও খুব একটা ছবি উঠানো হতনা। যা উঠিয়েছি, তা আমার নিজের স্বার্থে, অন্যকে দিব অথবা অন্য কারো দরকার হবে তার পরোয়া করিনি। কিন্তু উনি সবার ছবি তুলেছেন, সবার ছবি উনার কাছে আছে। তিনি নিজে যেচে সবাইকে ছবি দিচ্ছেন, ছবি উঠাচ্ছেন। সেল্ফ মুটিভেটেট একজন মানুষ যিনি আমাদের সবার মনে দাগ কেটেছেন। আজ খাবার শেষ হওয়ার আগেই, সম্ভবত দুপুরের দিকে ২টা বড় কেক অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন যেন আমরা সবাই শেষ খাবারের টেবিলটাকে সেলিব্রেট করতে পারি। আমরা সবাই তখন মানষিক ভাবে বুঝতে পারছিলাম; একজন অন্যজনকে হয়ত এই জন্মে আর দেখব না। সবাই সবার মত ব্যস্ত, দুই দিনের অতিথি হয়ে এসেছিলাম, এখন চলে যাচ্ছি। ঠিক জীবন যেমন চলছে ঠিক তেমনি, একটা সময় আসবে আমাদের যাওয়ার ডাক পড়বে আর আমরা চলে যাব সব ছেড়ে।


আমরাও চাঁদা তুলে খান সাহেবের জন্য ছোট্ট একটা উপহার দিয়েছি। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে উনি খুব বেশি পছন্দ করতেন। প্রায় সময় আমার সাথেই লবিতে বসে কথা বলতেন। একা একটা বাঙ্গালী ছেলে, প্রায় সময় টেবিলের এক কোনে থাকি, হই হল্লোডে খুব একটা যাইনা, এইটা ভেবেই হয়তো উনি আমার বেশি যন্ত্র নিতেন। সব সময় বলতেন, আমাদের সাথে থাক, খাও, একা কোথাও যাওয়ার দরকার নায়। অনেকটা গার্ডিয়ানদের মত। আমার সাথে উনার পরিবারের সকল সদস্যের ভাল একটা জানাশোনা হয়ে গেছে। ওনাদের পরিবারের ৫-৬ জন ছেলে মেয়ে এই ট্যুরে আছে। তাদের সবার সাথেই বাংলায় কথা বলে মজা করতাম। তারা বুঝতো কিন্তু বলতে পারতো না, সেই নিয়ে ক্ষেপাতাম। উনার বৌ এবং শালার বৌ চমৎকার মহিলা। সব সময় আমার খবর নিতো। আমাকে অবশ্য দাওয়াতও করেছে, যখন আমেরিকা যাব যেন তাদের সাথে দেখা করি। দেখা যাক, ভবিষৎ আমায় কোথায় নিয়ে যায়। আমি সময়ের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়েছি।


লোকটাকে মিস্ করছি। সবাই ডাকছিল রাতের প্যারিসকে দেখার জন্য। আজ আমার আর প্যারিস দেখার মুড নাই। আমি শোকাহত, নতুন পরিবারকে হারিয়ে। আর্শিবাদ/দোয়া করি সবাই যেন ভাল থাকে এই পরিবারের সব সদস্য।


কারলী আমাকে আজ ১টা কাগজ ধরিয়ে দিল এবং দুটো প্যাকেট ধরিয়ে দিল। বাসের মধ্যে আমাকে ছাড়াও বাকী যারা প্যারিসে থেকে যাবে সবাইকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের কোম্পানীর রুলস একটা রিভিউ ফর্মে রিভিউ লিখতে। আমি এত ভাল একটা ট্যুর গাইড আগে কখনো দেখিনি, কতবারই বা এই রকম বড় ট্যুরে গেছি। আমার সব কিছুই তাদের পছন্দ হয়েছে। তাদের স্কেনিয়া বাসটা দারুন পছন্দের ছিল, সাথে চমৎকার ড্রাইভার আর কারলীর মজার মজার কথা সব মিলিয়ে দারুন সময় কেটেছে। দুটো প্যাকেটের ব্যপারে বলছিলাম, ঐ দুটো প্যাকেট একটা ড্রাইভার ওয়াইন আরেকটা কারলীর টিপ এর জন্য। তাদের জন্য ১০০ ইউরো খোয়ালেও খারাপ লাগবেনা। তারা চমৎকার দুটো মানুষ। এতবড় পরিবারকে ১৩-১৪ দিন কোন ঝামেলা ছাড়া সামলীয়ে রেখেছে এটাই বা কম কিসের।


কাল সকালে টিমের সদস্যেদের সাথে নাস্তা করব কথা দিয়েছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি শুতে যাচ্ছি।

৬ষ্ঠ অগাষ্ট ২০১৫ - Paris, France – এ দ্বীতিয় দিন।


৭:৩০ মিনিটে এলার্মটার কর্কষ ডাকে ঘুম ভাঙ্গাল। কাল বিকাল থেকে মনের অবস্থা ভাল নাই। ব্যক্তিগত কিছু কারণও আছে, যা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্ত না করাই উত্তম। ঘুম থেকে উঠেই কাপড় পাল্টে গেলাম নাস্তার টেবিলে, উদ্দেশ্য নাস্তা করা নয়, কারণ সকালে ব্রাশ করে মুখ হাত ও ধুয়ে যাইনি। গ্রুপের সবাইকে নাস্তার টেবিলে পাব বলেই গেলাম। প্রায় সবাই ছিল। সবার সাথে কথা বলতে বলতে আনমনে নাস্তা করে ফেলাম। কফিতে চুমু দিতেই মনের পড়ল আমার আজ সকালের রুটিনের কাজগুলো করা হয়নি।


যেই রুমের দিকে ফিরব ঠিক করলাম, ফেইসবুক নটিফিকেশনে অফিসের এডমিন কিছু বিষয় নিয়ে ফলোআপ করছিল। কাজটা আমার কাছেই অর্পিত ছিল, যার কারনে ব্যাচারী বারং বার উড়ো চিঠি পাঠাছিল। এখন পালা ঐ কাজের কিছু অগ্রগতি করা। আমরা যারা কী-কমিউনেকশন নিয়ে কাজ করি তাদের কাজের ধরণ বাকী মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি ভিন্ন। কাজগুলোর সুযোগ তৈরী করা, জাল ফেলানো এর পর অপেক্ষার পালা বেছে বেছে কোন মাছটা ধরব। আরেকটু বিবরণ দিলাম। কাজগুলো এমন; শুরুর আগে ভবিষ্যত সম্পর্কে নিজেদের ধারণা করতে হবে। জেলেরা মাছ খুঁজতে নদীতে যায়, সম্পূর্ণটা উপর ওয়ালার উপর ভরসা করে। বার বার জাল ফেলে নদীতে মাছ পাওয়ার আশায়, মাছ আসলে ভাল না আসলে কিছু করার নায়। আমাদের ব্যপারটা জেলেদের মত, কিন্তু ফলাফল অবশ্যই পজিটিব, মিন টু সে, মাছ আসতেই হবে। এটলিষ্ট নৌকা চালানোর রসদ এবং মজুরীটা উঠে আসা চায়। নদীতে মাছ না থাকলে আমরা কি করি? হা হা হা... গুড কোয়াইসচন। এখানেই কী-কমিউনেশন পারসোনেলের পারফর্মের বিষয়। একবার না পারিলে দেখ শতবার, তবে একজায়গায় বার বার তবে নতুন জায়গায়ও জাল ফেলতে হবে। যেখানে পূর্বে জাল ফেলে মাছ আসেনি, সেই জায়গাটি কিন্তু ছেড়ে দিলে চলবেনা। কারণ মাছ আজ না হয় কাল এই জায়গাতে আসবেই।


এতো ঘুরিয়ে পেচিয়ে কেন বলছি? আচ্ছা ডাইরেক্ট পরিস্থিতি বলছি, এটি একটি ঘটনার উদাহরণ মাত্র। কোম্পানীর নতুন ৩০ জন লোক লাগবে, একটা বড় প্রজেক্ট সাইন হয়েছে, যার কারনে ৩ মাসের মধ্যে লোকগুলো কাজে পাঠানোর মত করে তৈরী করতে হবে। দুবাইতে আমাদের কোম্পানী যে ধরণের কাজ করে তাতে ইন সাইড কান্ট্রি মিনস দুবাইর ভেতরে কাজ করার জন্য মানুষ খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। আমাদের লোকবল হয়ত ইন্ডিয়া অথবা নেপাল অথবা ফিলিপিন অথবা পাকিস্তান অথবা সবগুলো থেকেই উপযুক্ত পাত্র খুঁজে একত্রীত করতে হবে। এখানেও অনেক নিয়ম আছে, বেতন, ভাতা সহ অনেক বিষয়ে কথা বলতে হয় এজেন্টদের সাথে। এজেন্ট শব্দটা বাংলাদেশে যেই পরিমান খারাপ অর্থ নিয়ে শুনায় বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। কথায় এবং কাজে কোন মিল থাকেনা ওদের। তাই তাদেরকে হাতের তালুতে রেখে জনবল নিয়ে আসতে হয়। এখন একটা রেজিষ্টারর্ড এজেন্টকে সমস্ত কাগজ দেওয়ার শেষ মুহুর্ত্বেও সে বলতে পারে আমি ইন্টাভিউ এর জন্য লোক খুঁজে বের করতে পারিনাই। তখন কি করা যায়? এখন যে নতুন প্রজেক্টটা নিলাম সেইটাও গেল, বন্ড সেইটাও গেল, মাঝখানের পরিশ্রমগুলোও গেল। সেইখানেই আমাদের মত লোকরা কাজ করে। ৩-৭ বা ততোধিক পার্টিকে কাগজে পত্রে একজায়গায় এনে, সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করানো থেকে শুরু করে ট্রেইনিং এবং পারফরমেন্স পর্যন্ত খেয়াল রাখতে হয়। আমাদের কাজ অন্যকে কাজ করতে সহযোগীতা করা, হট্টোগোল লেগে গেলে সেইখান থেকে বের করানো।


আরেকটা উদাহরণ দিই। আমি ৬ বছর আগে একটি কোম্পানীতে কাজ করতাম। ঐখানকার ভাইসপ্রেসিডেন্টের সাথে আমার দহরম, মহরম সম্পর্ক ছিল। আমাকে ভাল জানত তাই অনেক কিছু জানাতো, উনার উপদেশগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করতাম। একদিন অন্য একটা অফিসে ছোট একটা কাজে গিয়েছিলাম, ঐ অফিসে প্রায় ৪ ঘন্টা বসেছিলাম একটা ডকুমেন্ট কালেকশনের জন্য। সেই অফিসে একটা সুন্দরী মেয়ে রিসেপশনের পাশের কেবিনে সকাল ৯টা যে এসেছে সেই তখন থেকে আমি বের হওয়ার আগ পর্যন্ত দেখলাম নিজের নখগুলো সুন্দর করে সাজাচ্ছে। কোন কাজ করতে দেখলাম না। ফিরে এসে আমাদের ঐ বসকে জিজ্ঞাসা করলাম মহিলাটা কে? উনি বললেন, পাবলিক রিলেশনশিপ ম্যানেজার। বললাম কোন কাজ করেনা, শুধু হাতে নেইল পলিস্ লাগাচ্ছে। ওনি হাসলেন, আমাকে ওনার কেবিনে নিয়ে গিয়ে পানির বোতল হাতে দিয়ে বললেন, তুমি যে কাজটি পুরো এক বছরে করতে পারবে না সেই কাজটি ঐ মহিলা ১ ঘন্টার মধ্যে করতে পারবে। আমি জানতে চাইলাম কি কাজ? উনি ঐ অফিসের পুরোনো একটি গল্প বলতে শুরু করলেন, “পল ঐ অফিসে মেয়েটি চাকরি করে ৪ বৎসর যাবৎ, কেউ তাকে কোনদিন কাজ করতে দেখেনি, আমি নিজেও দেখিনি। অনেক লোক অনেক কথা বলে ঐ মহিলাকে নিয়ে, মাসের শেষে ৩০ হাজার দেরহাম বেতন নিয়ে দিব্বি আছেন। ঐ অফিসের বস এতে পাগল নন যে, এমনিতেই এতগুলো টাকা বেতন দিচ্ছে। ঐ কোম্পানী একটি কনষ্ট্রাকশন কোম্পানী। হাজার কোটি টাকা লেনদেন যেমন আছে, আছে সমস্যা এবং শত্রু। একদিন একটা ছেলে বিল্ডিংয়ের উপর থেকে পরে মারা গেল। মিউনিসিপেল্টি থেকে লোক এসে অফিস বন্ধ করে দেওয়ার পালা। মহিলাটি শুধু বলেছে আমায় ২ ঘন্টা সময় দিন। সমস্যা সমাধান না হলে তখন অফিস বন্ধ করে দিবেন। সাথে সাথে তার মারসেডিস বেঞ্চ নিয়ে বের হয়ে গেল, ঠিক ৪৫ মিনিট পর একটি ফোন কল আসল মিউনিসেপেল্টির অফিস থেকে তাতে নির্দেশ টিম ফেরতৎ নেওয়ার জন্য। মহিলা আসল প্রায় ২ ঘন্টা পর। তারপর সাধারণ অফিসের কাজ চলতে লাগল।” এখন মনে প্রশ্ন জাগল মেয়েটি কে, ওকি অনেক বড় ফ্যামিলির মেয়ে; না কোন ক্ষমতাবান মানুষের সাথে তার উঠা বসা আছে? আমাদের বস্ বলা শুরু করলেন আবার, নাহ্ ওর কোন বড় চ্যানেল নাই, ওর কোন ভাল ফ্যমিলি বা ক্ষমতা ধরের সাথে জানা শোনাও নাই। তাকে রাখা হয়েছে যেখানে যেই কাজটি অন্যকেউ করতে পারবেনা সেটা সে করতে পারার জন্য। মেয়েটির ৫ বছর বিভিন্ন ফরেন এজেন্সির সাথে কাজ করেছে, রুলস রেগুলেশনের ওপর ভাল দখল আছে, দেশের আইন জানে, সবচেয়ে বড় কথা কোথায় গিয়ে কথা বললে কাজ হবে সেটা সে জানে। এই জীনিসগুলো এমনি এমনি হয়নায়, সে প্রচুর সময় যেমন তার নেইল পলিশে ব্যয় করে তেমনি, কে কোথায় কোন কাজে আছে তার খবরও রাখে, সাথে যোগাযোগ ও রক্ষা করে, যদিও আমরা সবাই ঐ মহিলাকে বসে থাকতে দেখি। আমি কি বোঝাতে পারলাম? যাই হোক কোন রকম সমস্যাটা সমাধান করে রুমে আসলাম। আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম প্রচন্ড, কিন্তু পারলামনা। কি যেন স্বপ্নে দেখছি, কিন্তু মনে রাখতে পারছিলামনা। বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম। মাঝখানটাই আবুর সাথে কয়েক বার কথা হল। সে বেশ ক’বার আমার খবর নিল।


বিকাল ২:৩০ মিনিটের দিকে রুম থেকে বার হলাম গোসল সেরে। পেটে ছুঁচো নাচছে। সামনেই একটা বার্গারের দোকান থেকে ভুঁড়ি ভোজ করে পাতাল রেলে চড়ে বসলাম। ২ বার ট্রেন বদলালাম, কয়েকটি জায়গায় গেলাম, হাঁটলাম প্রায় ৫ কিলো মিটারের মত। বেশ কিছু ছবি উঠালাম। আজকে পেরিসে ৩২ ডিগ্রি গরম পড়ছিল। ঘেমে আধা গোসল সেরে ফেলেছি। বেশ কয়েক বোতল পানিও শেষ করলাম।


আজকে বড় ধরণের সমস্যা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমাদের হোটেলের কাছে একটি পাতাল রেলের ষ্ট্যশন আছে। আমি সিড়ি দিয়ে নেমে গেলাম ট্রেইন পর্যন্ত। অনেক খোঁজা খুজির পরও টিকেট কেনার কাউন্টার পেলাম না। সিড়ি বেয়ে উপরে যাইতে ইচ্ছে করছিলনা তাই ট্রেইনে চেপে বসলাম। মনে মনে ভাবছিলাম যদি চেকিং এ পড়ে যাই তবে খবর আছে। একেত বেড়াতে আসছি, তার উপর কোন ক্রিমিনাল কেস করে দিলে তো শ’য়ে শোয়াশের হবে। মেট্রো থেকে ২টি লাইন বদলাই মিউজামের নিচের আসলাম। দেখলাম শুরু হয়েছে চেকিং, বেশ কিছু চাইনিজকে চার্জ করছিল সাথে নিগ্রো, রাশিয়ান এবং এশিয়ান। আমিতো মনে মনে বললাম কাজতো সারছে। হাতে একটি পানির বোতল ছিল, মুখে ভেতর পানির বোতল তুলে দেখেও তাদের না দেখার ভান করে বের হয়ে পড়লাম। আমায় চেক করে নাই, ভাবতেই অবাক লাগছে। কারণ আমার পাশের জনকেও চেক করছিল, আমার ভাবটা এরকম ছিল, আমি কিছুই জানিনা, পানি পান করছি। যাক উপর ওয়ালা বড় বাঁচান বাচাঁয় দিল। আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ট্রেইনের টিকেট কিনি নাই তা নয়, আমি আসলে যে দিক থেকে নেমেছিলাম ঐটা ছিল ইমাজেন্সি এক্সিট, এ ব্যাপারটা ফিরতি পথে উপলব্দি করতে পারলাম। এমনিতে ফ্রান্সের লোকেরা কর্কষ প্রকৃতির হয়। আজ সুযোগে পেলে আমার যে কি করত সেটাই ভাবছি।


হাঁটতে হাঁটতে The Louvre – মিউজিয়ামের দিকে গেলাম, ভেতরে টিকিট কেটে দেখার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে বলে আর ভেতরে যাইনায়। বিশাল এলাকাটা একবার হেঁটেই ফিরে এসেছি। হঠাৎ Notre Dame de Paris দিকে যেতে মন চাইল কারণ ছাড়ায়। ট্রেনে চেপে বসলাম, এবার অবশ্য টিকেট নিয়েই বসেছি। ২০ মিনিটে পৌঁছালাম, হাটা শুরু করলাম ঐ খান থেকেই প্রায় ৫ কিলোমিটার, সাথে Saint Jacques, Palais de Justice দেখারও সুযোগ হল।


রাত সাড়ে আটটা বাজে, এখনো সূর্য অস্ত যাওয়ার নাম নায়। হোটেলের রুমে ফিরব বলে ঠিক করি। কিন্তু আবার খুদা লেগেছে। কিছুদুর হাঁটার পর ডোনার কাবাবে ডুকলাম, আচ্ছা মত করে খেলাম। তারপর পাতাল রেলে চেপে চলে আসলাম।

৭ম অগাষ্ট ২০১৫ - Paris, France – এ তৃতীয় দিন।


৬:১৫ মিনিটের এলার্ম টাইম সেট করেই রাতে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে এলার্মের ডাকেই ঘুম ভাঙ্গল। দেখি আমার রুমের শ্রীলঙ্কান পার্টনার গোসল সেরে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আমিও একলাফে উঠে ওয়ালেট থেকে কিছু টাকা বের করলাম আর কারলী (আমারদের ট্যুর গাইড)-র দেওয়া রিভিউ ফর্মটি নিয়ে নিচে আসলাম। আজ আমাদের পুরো টিম প্যারিস ছেড়ে যাবে। নাস্তার টেবিলে সবাইকে ৬:৩০ মিনিটেই দেখার কথা, আমি এখনো ফর্মটি পূরণ করিনি। হোটেল রিসেপশনে গিয়ে একটি কলম খুঁজে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাগজটি ভর্তি করলাম, কারলীকে দেখা যাচ্ছেনা। খোঁজ নেওয়াতে বুঝতে পারলাম ব্যাগ লোডিংয়ে ড্রাইভার ওয়াইন এর সাথে ব্যস্ত।


হোটেল থেকে বের হয়ে বাসের লোডিং বে এর দিকে ছুটলাম, দেখলাম কারলী ব্যাগ গুনছে। আজ সে কালো একটি টি সার্ট পরে আছে সাথে ব্লু জিনস। কান্ত দেখাচ্ছিল, উসকো খোসকো চুল, ডাক দিলাম কারলী। ফিরে তাকিয়ে এসে জড়ায় ধরল, এটা বিদায় বেলার সম্ভাষণ। হাতে কাগজটা দিলাম, সাথে একটা প্যাকেট দিলাম যেখানে তার টিপের টাকা ছিল। ওর হাসিতে বুঝতে পারছিলাম, আমাকে সে আশা করছিল। সে এও আশা করছিল তার পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত কিছু টাকা। বিদায় জানালাম।


রুমে ফিরে গিয়ে ব্রাশ করে আবার নিচে আসলাম। রেষ্টুরেন্টে সবাই ততক্ষনে চলে এসেছে, এক এক সবার সাথে কথা হল, বিদায় জানানো হল। আমিও নাস্তাটা সেরে রুমে গিয়ে আরেক বার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আমার রুম ছেড়ে দেওয়ার সময় দুপুর ১২টা, আবুকে গত রাতে একটা ম্যাজেস পাঠিয়েছিলাম। এখনো জবাব পাই নাই। সম্ভবত ব্যস্তছিল, ভাবতে ভাবতেই তার ফিরতি ম্যাসেজটা আসল। আমি ১১টার দিকে ঘুম থেকে উঠে গোসলটা সারলাম। ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের লবিতে এসে উপস্থিতি হলাম ১১:৫৫ মিনিটে। রিসেপশনকে জানালাম আমি রুম ছেড়ে দিয়েছি। আবু তার আরেকটা বন্ধুকে পাঠানোর কথা ছিল আমাকে নেওয়ার জন্য। সে সম্ভবত একটা কল দিয়েছিল আমার মোবাইলে কিন্তু নাম্বারটি আমার ফোনে দেখা যায়নি, যার কারণে ফিরতি কল করতে পারছিলামনা। ১২টার একটু কিছুক্ষণ পর ছেলেটা আসলো। শ্যামলা আমার মত গায়ের রংয়ের একটি টি শার্ট এবং জিনস পরা। রিসেপশনে এসে ডান বাম করতে লাগল, আমি ওর দিয়ে তাকিয়ে একবার জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম। তখন সে সাহস করে সামনে এসে আমার কাছ থেকে জানতে চাইল আমিই লেনিন কিনা? আমি হ্যাঁ বলে তার সাথে চলা শুরু করলাম। সিলেটের একটা ছেলে শুব্রত, কিন্তু ভাষায় তার সিলেটি টান না দেখে একটু অবাক হলাম। একটু অন্যমনষ্কও ছিলাম কিছু ব্যক্তিগত যৌক্তিক কারণে।


শুব্রত আবুকে ফোন করে জানালো আমাকে সে খুঁজে পাইনি। একটু রসিক মনে হল, ওর সাথে কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে র‌্যাল লাইন পর্যন্ত আসতেই আরেকজনকে পেলাম রুমন, সে কক্সবাজারের আবুর আরেক পরিচিত। নিজেকে এই মুহুর্ত্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। একটা মানুষকে নিতে যদি ২টা মানুষ আসে তবে স্বাভাবিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবাটাই তো স্বাভাবিক। হা হা হা... শুব্রতের আচরণ আমার কাছে মজার লাগছিল, আমার চেয়ে বছর তিনেক ছোট হবে। দুষ্টামি করতে করতে আবুর বড় ভাইয়ের বাসাই পৌঁছালাম। বড় ভাই অবশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।


কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম, তারপর পেট পুজা শুরু করলাম। আজকে দুপুরে কপালে ভাত জুটেছে অনেকদিন পর। রান্নাটা অনেক ভাল লাগল, খেয়ে বের হলাম আবুর সাথে দেখা করতে। আবুর আজকের কাজ মাত্র শেষ করল। দেখা হল একটা ট্রেইন ষ্টেশনে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেকদিন পর দেখা, কোলাকুলি করেই কুশল আসল জিজ্ঞাসা করেই হাটা শুরু করলাম ওর সাথে। বেশ কিছু জায়গায় ঘুরলাম যেমন, আর্ট ইউনিভাসিটি ব্রিজ (লাভ ব্রীচ), প্যারিস বীচ, সিটি করর্পোরেশনের সামনে কিছুক্ষণ ইভেন্ট দেখলাম, ট্রেনে করে গেলাম প্যারিস গেইট, হেঁটে সনজিলিজি ষ্ট্রিট, লু-মি্উজিয়ামের বাগান থেকে ফেত তলা তুলিরি মেলায় ঘুরে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলাম।

৮ম, ৯ম এবং ১০ম আগষ্ট ২০১৫ - Paris, France – এ চতুর্থ, পঞ্চম এবং শেষ দিন।

সকাল ৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম। চোখ মুছতে মুছতে ডান পাশে ফিরে দেখলাম আবু নেই, হয়ত উঠে গেছে অনেক আগেই। লুঙ্গিটা ঠিক করলাম সাথে গিঠ্ঠুটাও ঠিক মত দিয়ে যে মাটিতে পা দিব সেই পা’টা উপরের দিকে উঠিয়ে নিলাম। টন টন করে উঠলো পায়ের শিরা উপ শিরা। সাহস করে মাটিতে পাড়া দিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ভালবোধ করছিলাম। ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর টুথ পেষ্ট লাগিয়ে বাথরুমের দিকে যাব, কিচেন-এ আবু ডিম ভাজছিল। আমি স্নানটা করে আসলাম, দেখি খাবার রেডি।


গতরাতের খাবার পেট থেকে এখনো নামে নাই। তারপরও নাস্তার টেবিলে এক প্রকার জোর করে খেলাম। বৌদির (মংথেন দাদার বৌ) শরীর ভালনা। নতুন বাচ্চা হল মাত্র, আজ ৩৩ দিন তার উপর ডেলিভারী নরমার ছিলনা। আমার বৌয়ের অভিজ্ঞতায় উনার অবস্থা বুঝতে পারছিলাম। মহিলা বের হয়ে এসেছেন জানার জন্য আমাদের নাস্তার অবস্থা কি? আর কিছু লাগবে কিনা? আমি না বলে জানিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলাম, যেন আমাদের জন্য রান্না না করেন রাত্রের এবং দুপুরের। দুপুরেরটা রাজী হলেও রাতেরটার জন্য রাজী করাইতে পারলামনা। বললেন মংথেন দাদা রাগ করবেন। কিছু করার নাই বড় ভাই বলছে বলে কথা।


আবুর কথা বলতে গিয়ে তার ফ্যামিলি নিয়ে একটু বলতে হয়। আবুরা ৩ ভাই, বড় ভাই দেশে একটা ব্যবসা করেন সাথে এডোনিস জিমের পরিচর্যা করছেন, যেটা মেঝ ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল। মেঝ ভাই মংথেন দাদা, ইউরোপে আছেন ৮ বছরের মত সময়। মংথেন দা বিয়ে করেছেন বছর কিছু আগে। অনেক দিন পরে দেখার পরও তেমন বেশি কিছু পরিবর্তন দেখলামনা। চমৎকার ফিটনেস ধরে রেখেছেন, একটু ভাল লাগার সাথে হিংসেও হচ্ছিল। আমার বয়স ৩০ পেরোলো মাত্র কিন্তু শরীরের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন দিকে চলে গেছে, এক অংশ অন্য অংশের সাথে সমন্বয়ের বাইরে। আবু বছর তিনেকের চেয়ে একটু বেশি সময় ইউরোপে, মেঝ ভাইয়ের সাথেই আছে। দু’জনের সম্পর্ক বন্ধুর মত। আবুকেও দেখলাম তার মেঝ ভাইয়ের মতের মূল্যায়ণ করতে যৌক্তিক, মেঝ ভাইও তাই। চমৎকার একটা কম্পিনেশণ। শেখার অনেক কিছুই ছিল। মেঝ ভাই যখন বাড়িতে ছিলনা, আবু প্রায় প্রতিটি ঘন্টায় একবার বাসাই খবর নিচ্ছিল ওর বৌদির কি অবস্থা, কিছু লাগবে কিনা, শরীর অবস্থা ঠিক আছে কিনা, বাঁচ্চাটা স্বাভাবিক আছে কিনা। আবুর পারিবারিক দায়িত্ব দেখে নিজের মধ্যের মানুষটার ভেতরটাকে দারুণ লাগছিল।


১১টার দিকে আবুর সাথে পরিচিত বন্ধুদের দেখা হল একটা ষ্টেশনে। সবাই অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আনফরটুনাটলি আমরা দেরি করে ফেলেছিলাম। আমি হলে হয়ত আবুকে অনেক পিড়া দিতাম। কিন্তু আবুর বন্ধুগুলো অনেক ভালছিল। একবারও মনে হয়নি তারা কিছু মনে করেছে আমাদের দেরিতে। গতকালের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা Château de Brissac গেলাম, যে ছিল রাজার বাড়ি। তখনকার রাজারা কিভাবে মানুষকে কষ্ট দিয়ে এত বড় রাজত্ব তৈরী করেছে তা এই বাড়িটি না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। আমরা লাইনে দাড়িঁয়ে রাজ বাড়ির ভিতরে যাইনি, অবহেলাটা আমারই ছিল। আমার লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করা অসহনিয় মনে হয়। রাজার বাড়ির পাশ ঘেষে পিছনের অংশে গেলাম নগদ টিকেট কেটে, গত কয়েক সপ্তাহ আগেও টিকেট কাটা লাগতনা। গ্রীষ্মের ছুটিতে সবাই ভিড় জমানোর কারণেই হয়তো এই টিকেট সিষ্টেম বসানো হয়েছে। ভিতরে যেতেই র্কারভ গ্লাসের একটা রিফেক্সন প্যাভেলিয়ান দেখলাম। রিফ্লেকশনটা কিভাবে ছিল আমি বোঝাই বলতে পারবো না, তবে ছবিটা উলল্টো করে নিজের প্রতিবিম্ব করে দেখাছিল। আয়নাতে স্বাভাবিক ছবির ঠিক উল্টো অবস্থান।


সামনে যেতেই সুন্দর ফোয়ারা, আরেকটু এগুতে বিশাল বড় বাগান। বাগান পাশ কাটাতেই সারি সারি বড় বড় গর্জন গাছ পাশেই কৃত্রিম লেক। সবাই মজা করছিলাম, একটা সময় ক্ষুদায় কাতর খেতে বসলাম ভেতরকার একটা রেষ্টুরেন্টে। সবাই মিলে হালকা কিছু খেলাম, সময় যাষ্ট ফ্লাইং। সুব্রত ছুটি নেয় নায়, তার আজকের কাছ থেকে, আমাদের মাথাই ছিল শহরে পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যা ৭টার আগে। আবু বলছিল একটু নৌকা বাইত। আমি কখনো নৌকা বাইনি, মনের মধ্যে শয়তানের পোঁকা উঁকি দিচ্ছিল, তাই না করতে পারলাম না। উঠে পড়লাম একটা নৌকাতে। আমরা ছিলাম ৮ জন প্রতি ৪ জনে একটি নৌকা। আমার সাথে ছিল আবু, সুব্রত এবং রুমন। কিছু দূরে যেতেই সুব্রতকে পাড় করে দিয়ে খোকন মামাকে আমাদের সাথে নিলাম। জগতেই ইনার দুনিয়ার সব চাইতে ছোট সাইজের বড় শয়তান সাথে কাব্যতো আছেই। প্রথম দেখাতেই মাই ডিয়ার প্রকৃতির লাগছিল। শুনলাম কিছু কবিতা সাথে সুমনের একটা গান, সুন্দর গলা না হলেও গাওয়ার ছন্দ ছিল নান্দনিক। ভেতর থেকে আসছিল, কবিতার বুলিগুলো সাথে গানের ছন্দ। মনে প্রচুর কষ্টে পুষে আছেন বোঝা গেল। আমার চরিত্রের বৈপরিত চরিত্রের মানুষ। লোকটাকে অনেক পছন্দ হয়েছে।



রুমন ছবির উপর ছবি তুলছিল, ঘন্টা খানিকের মধ্যে প্রায় ৪০০ ছবি উঠিয়েছে। সুব্রতের মনের মধ্যে কাজে না যাওয়ায় শঙ্কা উকি দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাসছিল, মাঝে মাঝে গম্ভির। কাজে যাওয়ার কথা আস্বত্ত করতেই চেহেরা পরিষ্কার। হা হা হা…


সুমন মামা সহ আরো কয়েক সেই রকম মজা করছিলেন। ভাল লাগছিল তাদের সংগ, ভুলে গিয়েছিলাম আমি কে ২ দুদিনের জন্য।


আমরা প্রায় হালকা রোঁদে আধপোড়া হয়ে বার হলাম রাজ বাড়ী থেকে। ট্রেনে বসতেই সবার গা এলিয়ে গেল। সবাই দূর্বল কিন্তু আমার অবস্থা অন্যদের চেয়ে খারাপ। দুবাইতে গরম; কিন্তু ঘাম সহজে বার হয়না। হলেও কিছুক্ষনের মধ্যে ধুঁয়ে ফেলতে হয় অস্বত্বি লাগে। আজ গাম আমার শরীরের বাতাস নেওয়ার ছি্দ্র গুলো বন্ধ করে দিল। সমস্ত গাঁ জলছিল, মনে হচ্ছিল কেউ আমার গায়ে মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। আবুকে খুব করে অনুরোধ করছিলাম এমন একটি জায়গায় নিতে যেখানে আমার মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত একটু ধুঁয়ে নিতে পারি।


কিছুক্ষণ পর আমরা Republic ষ্টেশনে এসে পৌঁছালাম, কিছুক্ষণটা ১ ঘন্টারও উপর। সবাই বাইরে এসে পানি পানি বলে দিক বেদিক ছুটছিল। সবার শরীরের পানীর চাহিদা তখন বুঝতে শুরু করল। আবু মেগডোনাল্ট এ গিয়ে হালকা কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে তাদের শৌচালয়ের দিকে নিয়ে গেল। সাথে ২-৩জন সাথে ছিল। শৌচালয়ে ঢুকতেই ভেতর থেকে এক রকম সবাই গার্ড দেওয়া শুরু করেছে কারণ আমি আমার কাপড় খোলা শুরু করে খালি গায়ে পানি লাগানোর কাজ সারছিলাম। ইয়াপম্যান, দিজ্ গাইজ আর রিয়েলি গুড। আমার অবস্থা বুঝতে পারছিল। গাঁ ধুঁয়া শেষ করতে আবু কাগজের নেপকিন এগিয়ে দিল। পুরা প্যাকেট শেষ করলাম গাঁ মুছতে গিয়ে। বাইরে আসলাম সবাই মিলে, খাবার শেষ করলাম।


বাইরে এসে আড্ডা দিতে Montmartre –তে গেলাম। এই জায়গাটি এত উচু যে সেখান থেকৈ মোটামুটি পুরো প্যারিসকে দেখা যায়। ২৭২ টা সিড়ি পাড় করতে হয়। প্রথম দিন আমরা যখন টিমের সাথে এসেছিলাম এই জায়গাটিতে তখন উদ্দেশ্য ছিল রাতের খাবার খাওয়া। আজ আমরা দেখতে এসেছি আস-পাশের জায়গাগুলো। বসার জায়গা নাই বললেই চলে। একটু ডান পাশে আসতেই লোহার ঘেরা দেওয়া একটা খালি জায়গা পাওয়া গেল। জাম্প করে সবাই ঢুকলাম ঐ জায়গাটিতে, আজ সূর্য অস্ত দেখব তখন সময় প্রায় ৯:৩০ রাত। এখনও সূর্য তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এক বাঙ্গালি এল বিয়ার বিক্রি করতে। সবাই নিলাম একটা করে বিয়ার। আমাদের মধ্যে একজন খুব দরাদরি করছিল। আবু একটু ধমকের স্বরেই বলছিল বিয়ার বিক্রেতা যা চাচ্ছে দিয়ে দাও। ও বুঝতে পারছিল ঐ ছেলেটার কতটুকু কষ্ট হচ্ছিল কিছু বিয়ার বিক্রি করতে। ওর ঐ আচরনটা প্রচন্ড ভাল লাগছিল। কিছুক্ষণ পর সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসার দিকে ছুটলাম। রাত ১১:৩০ মিনিটের দিকে বাসাই পৌঁছালাম।


আমি বাসায় ঢুকেই সোজা গোসল খানায়। আমি গোসল সেরে বের হওয়ার আগে আবু খাবার রেডি করে রেখেছিল। তারপর সে পরিস্কার হয়ে এসে দুজন খেলাম। তারপর সেই ঘুম। সকাল ৯টায় খুম থেকে উঠে দুনিয়ার পায়ের ব্যাথা অনুভব করছিলাম। বুঝতে পারছিলামনা আজ বাইরে বের হতে পারবো কিনা। আজ বার হতেই হবে, তবে একটু দেরি করে বার হব। কিছু কেনাকাটা করতে হবে।


আবুকে খুব করে ধরলাম একটা বড় মলে যাব বলে। খোঁজ নিতেই বুঝলাম, রোববার সব কিছু বন্ধ। এক দুইটা মল খোলা আছে। প্রায় এর্য়ারপোর্টর কাছে। ঘন্টা খানিক সফর করলেই Aerobill mall পৌঁছানো যাবে। সকালে গোসল করা ছাড়া আমার বের হওয়ার অভ্যাস নাই। এমনও সময় ছিল, পানি দেখলে ভয় লাগত। মা জোর করে স্নান করতে বাধ্য করত। মাঝে মাঝে ১-২ দিন স্নান করিনি। এখন এমন অভ্যাস তৈরী হয়েছে স্নান করা ছাড়া বের হওয়া প্রায় অসম্ভব।


সকালে খেলাম, আবু পরিবেশন করল। বৌদি বের হয়ে আসল আমরা কি করছি দেখার জন্য। বড় ভাইয়ের সাথে কথা হল কিছুক্ষণ। খেয়ে বার হলাম। একটা ষ্টেশনে এসে সুব্রতের সাথে দেখা হল। Aerobill mall –এ পৌঁছালাম, সামনে ছেলেদের কাপড়ের একটা ষ্টলে ঢুকলাম। একটা টি সার্ট পছন্দ হল। আবু আর সুব্রতকে অনুরোধ করলাম কিছু নিতে, আমি অফার করলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, তাদের রাজি করাতে পারলামনা। টি শার্টের বিল দিতে এসে সুব্রতের বাঁধার মুখে পড়লাম। বিল সে দিবে। বুঝলাম বাজার করা যাবে না। এই শালারা আমাই বিল দিতে দিবে না।


আমার মেয়ে এবং মংথেন দাদার ছেলের জন্য কিছু একটা নিব বলে এসেছিলাম। পুতুলের দোকানে ঢুকলাম। ২টা পুতুল নিলাম, একটা আবু হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। সে এইটার বিল দিতে দিবে না। কিছু করার ছিলনা। একটার দাম দিলাম আমি অন্যটা সে। আমি যেটা কিনলাম সেটা মংথেন দাদার ছেলের জন্য, ও যেটা কিনল সেটা আমার মেয়ের জন্য।


এবার সত্যিই একটু রাগ করলাম তাদের উপর। যাক আর কিছু কিনবনা। বৌয়ের জন্য একটু খানি কসমেটিক কিনেই ফিরলাম। বৌয়ের কোন গেরান্টি নাই। আবার বলবে ইউরোপ গেছেন আমার জন্য কিছু আনলেননা। রিস্ক নিলামনা।


আজ বেশি কোথাও বেড়াবো না। শুধু মাত্র আইফেল টাওয়ারের কাছে বসেই আড্ডা দিয়ে সময় কাটাবো বলে ঠিক করলাম। দুপুর গড়াতেই আবুর ফোনে বড়ভাই মংথেনের ফোন। দাওয়াত দিল ওনার রেষ্টুরেন্টে যেতে। না করলামনা, গেলাম charlotte । বড় ভাইয়ের কলিকগুলো খুবই মজার লোক। সাংঘাতিক রকম দুষ্টামি করছিল আমরা যখন খেতে বসলাম। খেতে বসে মুরগির গুলাস নিয়ে আসল, আমি বড় ভাইকে বললাম মুরগি ভাললাগে না। উনি জানতে চাইলেন, গরু বা শুয়র খাই কিনা। আমি হ্যা বলাতে উনার চোখ কপালে উঠল। জানতে চাইল, বেশি সিদ্ধ না কম সিদ্ধ, আমি বললাম মধ্যম সিদ্ধ। কিছুক্ষণ পর গরুর গোলাস, সাথে রেড ওয়াইন, বিয়ার। পেটভর খেলাম, কিছুক্ষণ পর আবুর আরো কয়েকজন বন্ধু এসে যোগ দিল। খাওয়া শেষ করেই আইফেল টাওয়ারের দিকে ছুটলাম।


অনেকক্ষন আড্ডা দিলাম, সবাইকে কাছের মনে হচ্ছিল। কেন জানি মন খারাপ হচ্ছিল ফিরে আসতে, হয়ত সেই পুরোনো জীবনে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। মজার বিষয় আমার কাজের জীবনেও আমি আনন্দে কাটাই, কিন্তু কেন আমার তাদের ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলনা বুঝতে পারছিলামনা। কাল আমার সকালে ফ্লাইট। ফিরতে তো হবে। রাতের লাইট সো শেষ হল আইফেল টাওয়ারে প্রায় ১০:১৫মিনিটে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। বাসায় পৌঁছালাম প্রায় ১২টা, ভাগ্য ভাল শেষ ট্রেনটা মিস করিনাই।


এসে ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম। সকালে এলার্মে ঘুম ভাংগল। ব্যাগটা অনেকটা গুছানো ছিল। আজ আবুর ১০টাই কাজে যাওয়ার কথা। নিজের কাছে গ্লিট ফিল হচ্ছিল। ওকে ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। জানি ওর দেরি হবে, তারপরও সে আমার সাথে গেল। এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, কিছুক্ষণ ছিল। আমি একরকম জোর করে ওকে কাজে পাঠালাম। রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কবার ফোন করে আমার আপডেট নিতে খবর নিল। আমিও বোর্ডিং করলাম, একটা ম্যাসেজ দিয়ে জার্মানির দিকে আসলাম ঘন্টা খানিক সফর করে। সেখান থেকেই আমার ডাইরেক্ট ফ্লাইট ডুবাই।


দুবাই যখন পৌঁছালাম রাত ১১টা। ফারুক এবং পাবেল বার বার কল করছিল, আমি আসছি কিনা দেখছিল। জানালাম আমি যাষ্ট ফিরলাম। ফারুক এবং পাবেল নিতে আসল এয়ার পোর্টে। আজ ইমিগ্রেশন অনেকটা সময় নিল, প্রায় দেড় ঘন্টা লাইনে থেকে মুক্তি পেলাম। কম্পিউটারে কি যেন সমস্যা ছিল। এমনিতে এমন সমস্যা হয়না।


সবাইকে মিস করছি।


বসের সাথে পুরো ২ ঘন্টা মিটিং হল আমার ট্রিপের ব্যাপারে পরের দুই দিনের মধ্যে। মজার ছলে ওনাকে বলেই ফেলাম আমি ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছি। বসের আচরণ বলছিল, উনি আগামি ২ বছরের মধ্যে আমাকে ছাড়ার পরিকল্পনা করছেননা।



লন্ডন থেকে একটা আই মেইল আসল লিংডিন প্রোফাইলে, আমাদের ইন্ডাষ্টির একজন যব অফার করে বসল। ভালই লাগছিল, যাষ্ট ইউরোপ ঘুরে আসতেই নতুন কাজের ইনভাইটেশন। ধন্যবাদ দিলাম, জানালাম অবশ্যই আসব তবে এখননা। আমার আরো শেখার বাকী।


ধন্যবাদ, যারা আমার এই লম্বা লেখা পড়লেন। বিরক্ত হলে ক্ষমা করবেন।


সবার জীবনের সুখ কামনা করে এই দৈর্ঘ্য লেখার ইতি টানলাম।

Featured Posts

Recent Posts

Archive

Search By Tags

Follow Me :

  • Blogger Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
  • Facebook Basic Square
bottom of page