top of page

Switzerland

৩য় ওক্টোবর ২০১৫ - Florence, Pisa, Italy- তে আমাদের আজ তৃতীয় এবং শেষ দিন, Wilderswil, Switzerland –এ প্রথম দিন।


গতকালের মন খারাপ নিয়ে বসে থাকলে কি চলে। আজ আমাদের পিইচা (Pisa- Italy) ঘুরতে যাওয়ার কথা, তারপর সুইজারল্যান্ড। দিনের সূর্য্যটা দারুণ লাগছে নিজের কাছে। কেউ কানের কাছে একবারও এসে বলে যায়নি দিনটা আনন্দের কাটবে। দিন দেখলেই হয়ত বোঝা যায়, আমাদের সিক্স সেন্স হয়ত এভাবেই পরিচালনা করে। ঘুম থেকে উঠেই নতুন উদ্দমে ব্যাগ গুছিয়ে নাস্তার টেবিলে গেলাম। সময়ের চেয়ে মিনিট দশেক পিছিয়ে আছি, ব্যাগ লোডিং এবং নাস্তার টেবিলে উপস্থিতিতে। তাতে কি, না হয় আজ নাস্তা মিস করলাম। এমনিতেই ৬ কেজি ওজন বেড়েছে, দু’এক বেলা না খেলে কিছু হবেনা।


গাড়িতে উঠে বসলাম, হেডফোনে গান লাগিয়ে দিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম বাস ছাড়ার। সবাই এসে বসল একে একে, আজ আমি পেছনের সিটে বসে আছি। চাইলেই সামনে বসতে পারতাম। সামনে যাদের সাথে বসব তারা ওজনে এবং সাইজে আমার চেয়ে একটু বড়। আমি তাদের সাথে না বসে পেছনের সিটে বসার সিধান্ত নিলাম কারণ গতকালের দিনের ঘটনাগুলো এখনো লিখা হয়নায়। কমপক্ষে ২ ঘন্টা বসে, মনযোগ দিয়ে টাইপ করতে হবে। ল্যাপটপ চেক করে নিলাম আরেকবার, দেখলাম চার্জ জ্বলজ্বলে পূর্ণ অবস্থায় আছে। একটু চালাকী করে আমার সিটটা পেছনে হেলিয়ে দিলাম, তখনো আমার পেছনের জন জায়গায় এসে পৌঁছায়নি সেটাই ভাগ্য।


আমরা এখন তৈরী। বাস ড্রাইভার ওয়াইন শুরু করল তার চলা। কারলী আমাদের ট্যুর গাইড আজকের দিনে কি কি হবে এবং কালকের দিনের কিছু বিষয় নিয়ে নিদের্শনা দিয়ে যথাস্থানে বসে পড়ল। আমি শুরু করলাম আমার দৈনিক যুদ্ধ, দৈনিক গল্প শেষ করব বলে কথা দিয়েছিলেম বন্ধুকে এবং নিজেকে। পেছনটাতে একটু বেশি ঝাকুনি অনুভব করছিলাম যার কারণে প্রায় ৩ ঘন্টা লেগে গেল ৩ পৃষ্টারও কম একটা দিনলিপি লিখতে।

বাসটা ৪৫মিনিটের মধ্যেই পিইচাতে এসে পৌঁছাল। বাসের পার্কিং লডে ২০০ ইউরোতে বাসটি পার্কিং করে আমরা পিসার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা পথ শেষ করে পৌঁছালাম সেই কাঙ্খিত পিইচা স্থাপনাতে। ১১৭৩ সালে আধুনিক পিইচা বিল্ডিং এর স্থাপনা শুরু হয় এবং প্রায় আটশত বছর লাগে কাজ শেষ করতে। বিভিন্ন সম্রাট সম্রাজ্ঞি এর মধ্যে তাদের ক্ষমতার বদল করেছেন। ১৮৩৮এ ইটালিতে ভয়ানক স্নো (বরফ) ঝড় হয়। এতে পুরো পিইচা টাওয়ার হেলে যায়, অনেকে মনে করেছিলেন, বরফ গলে যাওয়ার পর টাওয়ারটি মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ভাগ্য ভাল আজকের পিইচা এখনো দাড়িয়ে আছে। একদল ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পিইচা শক্ত অবস্থান দাড় করানো জন্য। যেটি পড়ে ট্যুরিজম এ ব্যাবহার করা যাবে। ২০০১ সালে খুব সম্ভবত আবার পিইচা খুলে দেওয়া হয়েছে ট্যুরিষ্টের জন্য।




আমি অনেকের ছবি তুলে দিয়েছি, হেলিয়ে দুলিয়ে, যে যেভাবে চাইছিল। কেউ কেউ লাথি দিয়ে পিইচা ফেলে দিচ্ছিল ছবিতে, কেউবা হাত দিয়ে পিইচাকে হেলানো থেকে সোজা করার চেষ্টা করছিল তাও ছবিতে। আমিও চাইছিলাম আমার কেউ একটা ভাল ছবি তুলুক, সঠিক এঙ্গেলে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস ১-২ টা ঠিকমত ছবি নিতে সর্মথ হয়েছি। কিন্তু ঠিক মত কেটে ছবিটিকে বার করতে আমার অনেক সময় লেগে যাবে।


পিইসাতে ছবি তোলা শেষ করে বের হচ্ছিলাম মিটিং পয়েন্টের উদ্দেশ্যে, সময় বেঁধে দেওয়া থাকায় আরেকটু সময় থাকার ইচ্ছে থাকলেও ইচ্ছাকে জলাঞ্জলী দিয়ে পিইচাকে ছেড়ে চলে আসলাম। পিইচার আসপাশের এলাকায় অনেকগুলো দোকান দেখলাম। সব গিফট ষ্টল, বাঙ্গালীরাই এই ব্যাবসাগুলো চালাচ্ছে। আমরা যখন বের হচ্ছিলাম তখন দোকান খুলছিল। বাংলাদেশে খুব সকালে যেমনটি চা বা মুদির দোকান খোলে বিশেষ করে গ্রামে, দোকানের টিনের ডালাটি উঠানো হয়, তারপর কিছু আংটা দিয়ে একে একে দোকানের বিক্রিযোগ্য জিনিসগুলো সাজাতে হয় যত্ন করে। ঠিক তেমনিই ওরা এই দোকানগুলো সাজাচ্ছিল। আমাদের ট্যুর গাইড আমাদের ডাক দিল ফিরে যেতে, তার পেছন পেছন চলতে শুরু করলাম। বাসের কাছে পৌঁছালাম ১০ মিনিটের মধ্যে।


এখন আমাদের উদ্দেশ্য সুইচ বর্ডার। ওখানে বাস দাড়াঁবে, আমাদের অনেকের কাছে পাউন্ড, কারো কাছে ইউরো আছে। সুইজারল্যান্ড এ পাউন্ড এবং ইউরোর প্রচলন নাই। সুইজারল্যান্ডে সুইস ফ্রেঙ্ক চলে। টাকাগুলো এখন সুইচ ফ্রেঙ্কএ কনভার্ট করা লাগবে। আমার কাছে কিছু পাউন্ড ছিল সেগুলো বদলালাম, ইউরোগুলো রেখে দিলাম, ওগুলো ফ্রান্সে কাজে লাগবে। ডেবিট কার্ড থেকে ১০০ ফ্রেঙ্ক উঠালাম। ঐ সার্ভিস ষ্টেশনে খাবার দোকান আছে। আমি রীতিমত পন করে রুম থেকে বার হয়েছিলাম কোন ভাবেই আজ দুপুরের খাবারের জন্য ৫ ইউরোর বেশী খরচ করবনা। কিন্তু উপরওয়ালা সহায় ছিলেন না। খাবার তেমন দামী কিছুই খাইনাই, একটা সেন্ডউইচ এবং এক বোতল পানীর মূল্য আমাকে ১৪ ইউরো দিতে হল। পরে জানতে পারলাম সুইচে সব কিছুর দাম অন্য দেশের তুলনায় ৫ গুন বেশি। বাবা লেনিন তৈরী হয়ে যাও আরেক দফা খরচের জন্য। যাওয়ার সময় শুধু পেন্ট আর ল্যাপটপটা বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই যথেষ্ট।


আমরা সুইচ বর্ডার ক্রস করলাম। মোবাইলের নেটওয়ারক চলে গেছে, অনেক খুঁজেও পেলাম না নেটওয়ার্ক। পরে বুঝতে পারলাম আমার মোবাইল কোম্পানীর সাথে তাদেরও কোন চুক্তি নাই, কারণ হিসাবে সুইজারল্যান্ড ইইউএর সদস্য না। বর্ডার ইইউ সাথে খোলা থাকলেও তাদের সাথে কোন কালেই ইইউর কোন সম্পর্ক ছিলনা। ভবিষ্যতে হবে কিনা সন্দেহ। সুইজার ল্যান্ডে প্রতি ঘন্টা কাজের মূল্য মান ১৭ সুইচ ফ্রেঙ্ক (১৭ ইউরো সমান), আর একটা বার্গারের দাম কম পক্ষে ১৭ সুইচ ফ্রেঙ্ক। তাইতো বলি আজ আমার খাবারের উপর গজব পড়ল কেমনে? প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে এবং দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে সুইচরা অংশ গ্রহণ করেনি। তাদের যখন যুদ্ধে ডাকা হয়েছিল ফ্রান্সের পক্ষ থেকে, তারা বলেছিল আমরা যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে আমরা ফ্রান্সের সম্পদের সুরক্ষা দিব। ফ্রান্স সেই সুযোগটা নিয়েছিল, তারা অষ্ট্রিয়ার অনেক সম্পদ লুট করে সুইচ ব্যাংকে জমা রেখেছিল। সুইজারল্যান্ড প্রথম থেকে মদ্ধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিল। সবাই জানলে অবাক হবেন, পৃথিবীতে একমাত্র দেশ সুইজারল্যান্ড যেখানে কোন সরকার নাই। এখানে এলাকা আছে, প্রতি এলাকার একেকজন প্রতিনিধি জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হন, সেখান থেকে একজন সরকারকে লিড দেয়। এখানে সবার সমান অধিকার। সুইজারল্যান্ডের সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউকিপিডিয়ার সহায়তা নেন। আমি নিজেও ভাল করে এখনো জানিনা।


সুইজারল্যান্ড হাজার হাজার টানাল এবং বড় বড় ব্রিজে ঘেরা। পৃথিবীতে আরেক পরা শক্তির দেশ সুইচ। তাদের নিজেদের নিউক্লিয়ার বোমা আছে এবং সামরীক স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাদের ব্রীজ এমন ভাবে সিস্টেম করা আছে, কম্পিউটারে একটা ক্লিকএ ব্রিজগুলো সব ভেঙ্গে পড়ে যাবে। এতে বাইরের কেউ সহসা এই দেশটি আক্রমন করতে পারবে না। অথবা আক্রমনের পর বের হয়ে যেতে পারবেনা। এই দেশে প্রতিটি ছেলেকে ২ বছরের আর্মি ট্রেনিং দেওয়া হয়, এটা এমন একটা দেশ যেখানে ১ মিনিটের মধ্যে ৩৪ লাখ সেনা যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। সুইচে যারা আর্মি ট্রেইনিং নিয়েছে তারা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখার অধিকার সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টানাল সুইচেই আছে, যেটা ১৭ কিলোমিটার লম্বা, ওফ প্রায় ২৫ মিনিট গাড়ি চালিয়ে পার হতে হল টানালটি। রাস্তায় গাড়ি চলছে, আমরা হোটেল থেকে ১:৩০মিনিটের দূরত্বে আছি। কিন্তু যা দেখছি ডানে বামে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিনা। কোন এক অংকিত পৃথিবী মনে হচ্ছে। নীল পানির সাথে বড় বড় পাহাড়, সবুজে ঘেরা এবং বরফে ঘেরা। অস্বাভাবিক সুন্দর, হ্যাভেন বা স্বর্গতো আমরা কেউ বাস্তবে দেখিনাই। সুইজারল্যান্ড যারা দেখেছেন নিজের চোখে তারা স্বর্গের রূপ সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন এছাড়া অন্যন্য উপায় নাই। ইয়েজ ম্যান... দিইজ ইজ হ্যাভেন। প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের পাশাপাশি মানুষগুলো শহরগুলোকে অপরূপ সুন্দরে সাজিয়ে রেখেছে।


সুইচ ঘড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ঘড়ি। সুইজারল্যান্ডের মানুষগুলো সময়ের ব্যাপারে অসম্ভব শক্ত অবস্থানে। এক সেকেন্ড ডানেও না আবার বামেও না। সবাই যখন স্বর্নের ব্যবহারে ব্যস্ত তখন সুইচরা সুইচ ওয়াচ বা ঘড়ি বানিয়ে বিশ্ব মাতিয়ে রেখেছে। সব দামী কোম্পানীর ঘড়ি এখানেই বানানো হয় যা অলংকারের চেয়ে দামী। তারা সব সময় একটা কথা বলে, সময়ের চেয়ে পৃথিবীতে অন্যকোন কিছু দামী না। এটাই সত্য। টাকা, গয়না গেলে ফিরে আসবে কিন্তু সময় চলে গেলে কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না।


আমার এক বন্ধু এবং সহকর্মী আমাকে ওয়াটসাপে ম্যাসেজ পাঠালো আমাকে কেন ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি একটু রেগে বলেছিলাম এরা বদ তাই ইইউ-এর সাথে তাদের চুক্তি নাই, তাই আমার ফোন কোম্পানীর সাথেও তাদের চুক্তি নাই, অতএব আমি ২ দিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবো। ও ফিরতি ম্যাসেজে সুইচদের চৌদ্ধগুষ্টি এক করছিল। আমি আরেকটা ভয়েস ম্যাসেজে বলছিলাম সুইচরা জার্মানদের চেয়েও বদ। সময়ের ব্যাপারে জঘন্য রকম খারাপ। ম্যাসেজটি শেষ করতেই আমাদের সাথে থাকা এক বাঙ্গালী মহিলা উনার স্বামী আর আমাকে ডাকছিলেন রাতের খাবারে যোগ দিতে। আমাদের খাবারের সময় ৭:৩০ মিনিটে। আমি আর আপা ৭:২৯ মিনিটে খাবারের ডাইনিং এ ঢুকছিলাম, ডাইনিং এর দরজা তখনো হালকা করে বন্ধ করাছিল। হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল, ভেতরে দেখলাম টেবিলগুলো আমাদের জন্য সাজানো আছে। ভেতরে এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা কি বসতে পারি। মহিলাটা আমাদের বলল, খাবার ৭:৩০মিনিটেই শুরু হবে, আমরা নিজেরাই আপনাদের জন্য দরজা খুলে দিব, আপনারা বাইরে অপেক্ষা করেন। আমি আর আপা বের হয়ে আসলাম এবং বাইরে চেয়ারে যেই বসব তখন ৭:৩০মিনিট এবং দরজা খোলা হয়েছে। মাত্র ১ মিনিটের ব্যবধানে ওরা আমাদের সাথে এই ব্যবহারটা না করলে ক্ষতি ছিলনা। যেকোন মানুষ সময়ের একটু আগে আসলে খুশি হয়। এদের কথা তুমি আগে এসে লাইনে দাড়ায় থাকবে, টাইম মত দরজা খুলবে, সময় মত কাজ শেষ করে বের হয়ে যাবে। আমি যাষ্ট কিছুক্ষন আগে আমার বন্ধুটিকে যে ভয়েস নোটটা পাঠাই ছিলাম সেটা ঐ বাঙ্গালী ভাইয়া শুনেছেন। ওনি নিজেও অবাক হয়েছেন আমার কথা আর তাদের কাজে মিলে গেছে এই ভেবে।


অনেকদিন পর আমার বাচ্চাকে দেখলাম ইমোতে, ইইউ জোনে আসার পর ইমো ব্লক করে দেওয়া হয়েছিল। স্কাইপিতে জিএসএম পারফর্মেন্স ভাল না থাকায় অপেক্ষা করছিলাম ভাল একটা সুযোগের। ভাল লাগছে মেয়েটিকে হাসি খুশি দেখতে। আজকে আমার মেয়ে তার হাত কোনটা, পা কোনটা, পেট কোনটা, কান কোনটা এই সব দেখাচ্ছিল। আইডেন্টটি ফিকেশন নোট তৈরী হচ্ছে ওর ব্রেইনে। ভাল লাগে যখন দেখি সবাই অনেক খুশি আছে।


হোটেল থেকে যে রুমগুলো আমাদের দেওয়া হয়েছে এই রুমগুলো ছবির মত সুন্দর। খুবই সাধারণ এবং অসাধারণ করে সাজানো। নিজের চোখে কেউ না দেখলে বোঝানো যাবেনা।


কাল আমাদের অনেক লম্বা এবং সুন্দর একটি দিন আরম্ভ করতে যাব। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাচ্ছি।


৪র্থ অগাষ্ট ২০১৫ - Wilderswil, Switzerland –এ দ্বীতিয় দিন।

আজকের সকালের আলোটা অন্যরকম সুন্দর। সূর্য্যের আলো জানালা দিয়ে কাঠের ঘরের মধ্যে উকি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাল। বালিশের কাছে থাকা মোবাইলটা হাতড়িয়ে সময় দেখলাম; এলার্ম বাজতে এখনো ১০ মিনিট বাকি। একটু ডানে বামে করে উঠে পড়লাম। আজ ব্যাগ গোছাতে হচ্ছেনা। এই হোটেলে দুইদিন থাকবো। গোসলটা শেষ করে এক জোড়া হালকা, এক জোড়া ভারী কাপড় নিয়ে নিচে এলাম, নাস্তা শেষ করলাম ৮:২০ মিনিটে। আমাদের গাইড আমাদের Jungfrau (ইয়াংফ্রা) নিয়ে যাবে। এখানেই আমাদের সারাটা দিন কাটবে।

আমরা আমাদের গাইডের হাক ডাকে পিছু নিলাম। মিনিট ১৫ পর ট্রেন ষ্টেশনে এসে পৌঁছালাম। ইয়াংফ্রা ভ্রমনের সাধারণ ভাড়া ২৬০ সুইচ ফ্রাঙ্ক (২৬০ ইউরোর কাছাকাছি)। আমারা যেহেতু একটা গ্রুপে যাচ্ছি তাই প্রতিজনে খরচ পড়ছে ১৭০ সুইচ ফ্রাঙ্ক। সবাই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সাথে ছোট এই মফস্বলের আশে পাশের পাহাড়, গাছ, ঘাস তথা পরিবেশটার আনন্দ উপলব্ধিতে নিচ্ছিল্লাম। নিশ্বাসে এক সুন্দর গ্রাণ। ছবির মত একটা জায়গা, নিজেকে নিজে বিশ্বাস করাইতে কষ্ট হচ্ছে। এত সুন্দর পৃথিবীর একটা অংশ কিভাবে থাকতে পারে, যার তুলনা শুধু স্বার্গের সাথে করা যায়।

ইয়াংফ্রা হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের তথা ইউরোপের সবচেয়ে উঁচা পাহাড়। মাটি থেকে ৪,১০০ মিটারেরও উপরে এর অবস্থান ১২,০০০+ ফিট, যেখানে পাহাড়ের সাথে বরফের মিলনস্থল। ১০২ বছর আগে সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ে উঠতেপারা ট্রেইন লাইনের স্থাপনা করা হয়েছে। ৪,১০০ মিটার উঠতে ৩টা ট্রেইন বদলাতে হয়। ২ ঘন্টারও বেশি সময় ট্রেইনে বসতে হয়, ট্রেইনটি ধীরে ধীরে চলে। ট্রেনের অবকাঠামোগত দিক থেকে অন্য ট্রেনের সাথে তেমন বেশি কিছু ব্যবধান দেখছিনা। সাধারণ ট্রেইন ২টা লাইনের উপর চলে, এই ট্রেইনটি ৩টা লাইনের উপর চলে। মাঝের লাইনটি সাইকেলের পেডেলে থাকা পিনের মত শিকল আটকানো ঘাট। যাতে ট্রেনেরে মটরের শিকল ঐ পেডেলে জড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে পারে। ট্রেইনটি মাঝে মাঝে ৪৫ ড্রিগ্রি এঙ্গেলে উপরের দিকে উঠতে থাকে, সমান গতিতে। কোন ঝাকুনি নাই, কোন আওয়াজ নায়, তার কারণ হচ্ছে এই ট্রেইনটি ইলেট্রিকে চলে। প্রতিটি ট্রেইন দেখতে আলাদা আলাদা ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা। এই ট্রেনগুলো খুব একটা ভারি মনে হলনা, অনেকটা ট্রামের মত পাতলা, তবে নিচের প্লাটফর্ম পুরো ধাতব দিয়ে তৈরী।

প্রথম ট্রেইনে উঠলাম সমতল দিয়ে চলছে, গতি ৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। চলন্ত অবস্থায় ডানে-বামে দেখছিলাম বারংবার, চোখের সেই কি শান্তি। যতই দেখি মন ভরেনা। ঝরনা, পাহাড়, বাগান, ছোট ছোট ঘর পাহাড়ের উপর, বড় বড় গাছের ঝাড়, এখানকার গরুর গলাই বিশাল বড় ঘন্টা। দেখতে দেখতে ৩০ মিনিট কখন পার হয়ে অন্য প্লাটফর্মে আসলাম নিজেও জানি না। বের হলাম ঐ ট্রেইন থেকে, আমাদের জন্য আরেকটি ট্রেইন অপেক্ষা করছে, সেইটাতে চড়ে বসলাম। এবার এই ট্রেইনটি উপরের দিকে উঠা শুরু করল, যত উপরে উঠছে, ঝরনাগুলো কাছে থেকে দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে সুড়ঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেইন। এখন বরফের পাহাড়টিকে কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। ৪০ মিনিটের মধ্যে ২ বার বিরতি দিল দুইটা পাথরের প্লার্ট ফর্মে। যেখানে গ্লাসের মধ্যে থেকে দুই ধারের বড় বড় বরফের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। তারা বলছিল ছবি নেওয়ার জন্য আমাদের বিরতি দেওয়া হয়েছে। আমি ভাবছি ভিন্ন কথা। ৫ মিনিট প্রতিটা ট্রেইনের ইঞ্জিন বিরতি নিয়েছে, যাতে ট্রেইনের ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে আগুন লেগে না যায়। ৪০ মিনিট পর আরেকটা প্লাটফর্মে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে একটা লাইন বদলায়ে পড়ের ট্রেইনে চেপে বসলাম। এখন আমাদের ট্রেইন উপরের দিকে উঠছেতো উঠছে, পথের শেষ প্রান্তে ১৫ মিনিটে চলার পথ একটি পাহাড়ের ভিতরে এসে পৌঁছাল। আমরা সবাই নামলাম। একটু শিত শিত লাগছিল, সুয়েটারটি পড়ে নিলাম। প্লাটফর্মে এসে একটি লিফটে করে ৪ তলা উপর উঠলাম। একতলা হেঁটে সেই কাংখিত পাহাড়ের চুড়াই পৌঁছালাম। খুব বেশি ঠান্ডা ছিল, কিন্তু খুব বেশি ঠান্ডা অনুভুত হচ্ছিলনা। অনেক মজা করলাম, লাফা লাফি করলাম। ঘন্টা দেড়েক পরে নিচে নেমে এসে খেলাম।

আমার মাথাসহ গাড় ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম, যথেষ্ট অক্সিজেন পাচ্ছিনা। এর কিছুক্ষনপর আমার অবস্থা সেই খারাপ, মাথা ভারী হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে মাথা ঘুরায়ে পড়ে যাব। ২ তলা নিচে নেমে একটা অক্সিজেন সার্পোট এরিয়াতে বসলাম। ততক্ষনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে, মাইগ্রেনের ব্যাথার মত মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। অতি সুন্দরের ঝলক সহ্য করা আমার মত স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে স্বম্ভব না হওয়ারই কথা। আমি শুধু মনে করেছি এই সমস্যা শুধু আমার, কিছুক্ষন পর আমাদের টিম লিডার বলল প্রায় ১০-১২ জনের একই অবস্থা। আমাদের অক্সিজেন গ্রহনের রগের লাইন স্বম্ভবত একটু ছোট।

আরেকবার সাহস করে উপরে উঠতে চাইলেও পারলামনা। ব্যাথা শুরু হয়েছে খুব খারাপভাবেই। সময় গুনতে লাগলাম, কখন এখান থেকে বের হওয়া যাবে। ২:৩০ মিনিটে আমাদের ফিরতি ট্রেইন এখনো ৩০ মিনিট বাকি, একটা রেষ্টুরেন্টর কোনায় চুপ করে মাথা নিচু করে ১৫মিনিট বসে থাকলাম। তারপর প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলাম। দেখলাম আমাদের ট্যুর গাইড সবার জন্য অপেক্ষা করছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই ট্রেইনে উঠে বসলাম। ৫ মিনিটে ট্রেইন ছাড়বে। আসার সময় উপচে পড়া ভিড় ছিলনা। ফিরে যাওয়ার সময় দেখলাম অনেক লোক ট্রেইনে দাড়িয়ে আছে। আমাদের কম্পান্ডমেন্টে একদল বয়সষ্ক মানুষ উঠে আসল। সবাই তাদের জায়গা ছেড়ে দিল, আমরা ৪-৫ জন তাদের জায়গা ছাড়তে পারলাম না। আমাদের এতই অবস্থা খারাপ যে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়েছি। আমাদের ট্যুর গাইড অবস্থাটা বুঝে তাদের অন্য জায়গায় বসার সুযোগ করেদিল। জীবনে এই প্রথম কোন বৃদ্ধকে বসতে না দিয়ে স্বার্থপরের মত নিজের জায়গা বসে থাকলাম। নিজের কাছে ছোট মনে হল, এরকম কখনো হয়নি আগে। হাসি মুখে মহিলা অথবা বয়স্কদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছি কতবার তার কোন হিসাব নাই।

সুন্দরের কোন বিবরণ হয়না, আমি সুইজারল্যান্ড সম্পর্কে ভুল বর্ণনা দিয়ে প্রকৃতিকে ছোট করতে চাইনা। এমন কিছু সুন্দর আছে, যাকে বিবরণ দিয়ে বোঝানো যায়না। যেমন মায়ের ভালবাসা সন্তানের প্রতি, আমরা বুঝি কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনা।

সুইচদের বিষয়ে কিছু বলতে চাই। সুইচরা ঘরের দরজা কখনো বন্ধ করেনা। চুরি হওয়াতো দুরের কথা, কেউ রাত্রে দরজার কড়া নারে না। ১৯৭০ সাল থেকে প্রতিটি ঘরের সাথে বাংকার (আন্ডার গ্রাউন্ড লোহার ঘর) থাকা বাধ্যতামূলক করেছে এখারকার অথরিটি। যেন যে কোন বিপদে সেই ঘরে এসে আশ্রয় নিতে পারে। এমনটি নিউক্লিয়ার হামলা হলেও, সুইসরা যেন রক্ষা পায়।

সুইচরা ইলেক্রটিক ডিভাইস ব্যবহারের চেয়ে মানুষের সাথে মানুষের কথা বলাকে সমচেয়ে সামাজিক এবং স্বাছন্দ মনে করে। সেজন্য একটি নিয়ম চালু করেছে। কেউ খাবার টেবিলে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবেনা। তাই আমরা যখন ডাইনিংয়ে ঢুকি আমাদের ফোন, ল্যাপটপ রুমের মধ্যে রেখে আসি। এটা একটা ভাল নিয়ম। আমাদের নিজেদের মধ্যে এই অভ্যাসটা চালু করতে হবে। এটা চালূ ছিল ২০০৫ সালেও। যতই মোবাইলে ইন্টার সুবিধা বাড়ছে আমরা একে অন্যের থেকে দুরে চলে যাচ্ছি।

আজ আমরা হোটেলেই খাব, খাবারের কথা বলতাম না। আজকের খাবারটা এশিয়ান সুইচ মিশানো। ছোট ছোট করা রুটির টুকরা টেবিলে দিয়ে গেল, একটুপর একটা ছোট চুলা দিয়ে গেল তার উপর চিজ গরম হচ্ছে। এখন কাটা চামচ দিয়ে রুটির সাথে গরম চিজ মাখাইয়ে খাও। স্বাদটা ভালছিল। বাকিগুলো প্রতিদিনের মতই।

সুইচদের নিজেদের ভাষা নাই, তাদের কিছু অংশে ফ্রেন্স ভাষা, আর কিছু অংশের লোকেরা ইটালিয়ান সুইচ ভাষা ব্যবহার করে। তারা ইংরেজী ভাল বোঝে ও বলতে পারে। অনেকটা অষ্ট্রিলিয়ানদের মত, অষ্ট্রিলিয়ানদের কোন নিজেদের ভাষা নায়। তাদের সরকারী ভাষা ইংরেজী।

ক্লান্ত লাগছে। আজ জলদি ঘুমাতে যাব।

Featured Posts

Recent Posts

Archive

Search By Tags

Follow Me :

  • Blogger Social Icon
  • LinkedIn Social Icon
  • Facebook Basic Square
bottom of page