Prague; Czech Republic
২৭ জুলাই ২০১৫ - Rhine Valley এবং Nuremburg, Germany আজ দ্বীতিয়তম দিন, Prague; Czech Republic এর প্রথম দিন।
সকাল ৬:১৫ মিনিটে এলার্মে ঘুম ভাঙ্গল। গোসল সেরে ব্যাগ, কাপড় রেডী করে নিচে এলাম নাস্তা করব বলে। অবশ্য কাল রাতে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম, জানি যে আজ হোটেল ছেড়ে প্রাগ, চেক রিপালিক যাব। মাঝখানটাই নামবার্গ এ একটু ঘোরাঘুরি করব। আমাদের ড্রাইভার এর বয়স ৬০ এর কাছাকাছি অথবা সামান্য কিছু কম হবে, একটু বেশি মোটা, সাদা এবং ক্লিন সেইভ, ভুড়িটা সামনের দিকে বাড়ানো। আমরা ৫০ জন লোকের ব্যাগ সে একা একটা বাসের লোডিং বেস এ ভাজ করছিল। মায়া হচ্ছিল, আমরা এতগুলো বুড়া ধামরা থাকতে সে এত বড় বড় ব্যাগ গুলো লোডিং এরিয়ার মধ্যে একে একে ডুকাচ্ছে। আমি সাহায্য করার প্রস্তাব দিলাম। মুখের উপর না করে দিল। মানুষটা অনেক মজার। ওর কথা লেখার মাঝখানে আরেকবার সুযোগ হবে।
জার্মান নাস্তা ভাল রসাল মনে হলনা, বেরসিক নাস্তা। ডিম, বিভিন্ন রকমের রুটি, কয়েক ধরনের তরকারী, কিছু জুস, চিজ্, বাটার, দুধ আরো অনেক কিছু। নাস্তা পরিবেশনে তাদের কোন অপরাধ নাই। স্বাস্থ্যকর সকালের নাস্তা এর চেয়ে ভাল কিভাবে করা যায়। সমস্যা হল আমিতো বাঙ্গালী, মুখে পরটা দিয়ে মুখ ডাল অথবা মাংসের ঝোল চুবাই চুবাই না খাইতে পারলেতো খাইছি মনে হয়না। প্রায় ৮ বছর দেশের বাইরে, অনেক কিছু বদলাতে পারলেও খাবারের অভ্যাসটুকু বদলাতে পারি নাই। মাঝে মাঝে অন্য দেশের ক্রজিন চেকে দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু তৃপ্তি করে খাওয়া বলতে বাংলা খাবার। তারপরও মুখে কিছু গুজে দিয়ে কফি হাতে বার হয়ে আসলাম। দেখলাম ইয়ান- মানে আমাদের ড্রাইভার তৈরী হয়ে আছে। তার হাতেও বড় এক কফির কাপ।
বাসে উঠে বসলাম, আমাদের টিম লিডার আমাদের জন্য নতুন একটা খেলার আয়োজন করে রেখেছে। সে বলা শুরু করল “প্রিয় বন্ধুগণ, আমরা আজ প্রায় ৩দিন একসাথে আছি, আমরা একে অপরকে চিনলেও আলাপ হয়নি। আমাদের আলাপ হওয়া দরকার। আলাপের একটা রুলস বলে দিচ্ছি। বাসের জানালার পাশে থাকা ব্যাক্তি-ব্যাক্তিনিকে জায়গা থেকে সরতে হবেনা, কিন্তু পাশের বসার সিটের জনকে পিছনে যেতে হবে এক এক করে। সবাই আলাপের জন্য সময় পাবে ২ মিনিট।” প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে কি? পরে বুঝলাম আইডিয়াটা দারুণ। এর মাঝখানে ইয়ান (ড্রাইভার) গাড়ী থামাল সিগন্যাল-এ। সিগন্যাল তখন লাল, হঠাৎ ইষ্টিয়ারিং ছেড়ে আমাদের মধ্যেখানি এক খানা সিট নিয়ে বসে পড়ল, আমরাতো হতবাগ। সে গাড়ি ছেড়ে আমাদের মাঝে তাও আবার রাস্তার মাঝখানে। তখন মজা করে বলল, তোমরা খেলবে আমি বাদ যাব কেন। আমিও তোমাদের সাথে খেলব। সিগন্যাল সবুজ হওয়ার আগে অবশ্য সে তার নিজ স্থানে ফেরৎ গেছে।
শুরু হল খেলা- আমার পাশে ছিল ডিলন (শ্রীলঙ্কান), আমি ছিলাম জানালার পাশে, আমাকে সরতে হয়নি। সামনের একজন আমার পাশে এসে বসল, সেই শুরু কথা, পরিচয় পর্ব, দুই মিনিট হতেই সিট পরিবর্তনের নির্দেশ। ৩০ মিনিট সময় পেলাম পরিচিত হতে, অনেকের সাথে পরিচয় হল, অনেক কম সময়ে অনেক কথা হল, পুরো বাসে মনে হচ্ছিল কোন অনুষ্ঠান চলছে। অনুষ্ঠানে যেমন অনেক কথা হয় আওয়াজ হয় কথার, চিৎকার করে কথা বলতে হয় যেন পাশের জনের কানে আওয়াজ যায়, ঠিক তেমনি। আমার খুবই ভাল লেগেছে কারণ গুরুত্বপূরর্ণ কিছু মানুষের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। সাধারণতঃ পরিচয় পর্বে মানুষ যেভাবে পরিচিত হয়, তাতে একটি মানুষ অন্য একটি মানুষকে ২% জানার সুযোগ পায় সর্বোচ্চ। আজকের এই কথার ছলে পরিচিত হওয়া আমায় এক-একজন লোককে ১৫% জানার সুযোগ দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই পরিচিতিটা কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধ্য হয়তঃ সাধন করা যাবে। আমি একটা কোম্পানীর যোগাযোগ ব্যবস্থাপক, মানুষের যোগাযোগের আদিযুগের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে আমরা এখনো ব্যবসা করে যাচ্ছি। আজকের খেলার ছলে যে পরিচয় বা যোগাযোগটা মাধ্যমটা শিখলাম সেটা ভবিষ্যতের কাজের দুনিয়াতে নতুন অগ্রগতি নিয়ে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। তবে জানলে হবেনা, প্রয়োগ করতে হবে। এইটা একটা পিকনিক ছিল, তাই প্রয়োগটা সহজ ছিল। এখন আমাকে এই যোগাযোগ প্রক্রিয়াটিকে বিষেশায়ীত করে ব্যবসায় যোগাযোগে প্রয়োগ করতে হবে। এই জন্য অনেক সময় বরাদ্ধ করতে হবে প্রয়োগীক পদ্ধতিটি খুঁজে বার করতে। খুঁজে পেলে সবাইকে জানাবো, হয়ত কারো কাজে লেগেও যেতে পারে।
বাসে যেতে যেতে অনেক কিছুই চিন্তা করছিলাম এই মজার পরিচয় পর্বটাকে নিয়ে, কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম ভাবতে ভাবতে জানিনা। টিম লিডারের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গাল। আমাদের বাস ২ ঘন্টা পর নামবার্গ পৌঁছাল। দৃষ্ঠি নন্দন পরিবেশের একটি শহর। বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে ভেঙ্গে যাওয়া দালানগুলো চোখে পড়ছে। আমরা মোটামুটি হিটলার সম্পর্কে জানি। আমি খুব কমই জানি। যা জানলাম তার সংক্ষিপ্ত আপনাদের সমীপে জানানোর চেষ্ঠা করলাম।
হিটলারের জন্ম অষ্ট্রেয়াতে, প্রচন্ড বক্তৃতা পটু লোক ছিলেন। জন্ম ১৮৮৯, NSDAP পার্টির সদস্যে ছিলেন। একবার জেলে গিয়ে কাটিয়েছেন ৫ বৎসর। ফিরে এসে জনগনের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পান। এক সময় তার হাতে ক্ষমতা চলে আসে এবং দ্বীতিয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় অসংখ্য যিউস (Jews) জনগনকে নিমর্মভাবে হত্যা করেন। হিটলার যিউসের ঘৃণা করতেন। অনেকে মনের করেন তার ঠাকুমা ছিলেন যিউস এবং হিটলারের মাকে অত্যাচার করেছেন তার জন্য তিনি যিউসদের পছন্দ করতেন না। কেউ বলে, হিটলার যিউস প্রেমিকা দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, তাই তাদের প্রতিঘৃণা। সবকিছু ছাপিয়ে সত্যিকার অর্থে হিটলার যিউসদের অপছন্দ করতেননা। জার্মানরা যিউসদের পছন্দ করতনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানীতে যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল তাতে জার্মানরা মনে করে যিউসদের কারণে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্ঠি হয়েছে। জার্মান তখন লিডারশীপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। অনেক লিডার থাকার পরও জার্মানদের মনে জায়গা পেলনা। হিটলার শুধুমাত্র জার্মানদের মানষিক অবস্থান নিয়ে খেলা খেলেছিলেন এবং ক্ষমতা এসেছিলেন। জার্মাদের খুশি করতে লাখো লাখো যিউসকে হত্যা করেছেন। জার্মানীতে অনেক হলোকাষ্ট (Holocaust – বন্দি শিবির) এখনও আছে ইতিহাসের নির্দেশক হিসাবে। হিটলার শুধুমাত্র যিউসদেরই হত্যা করেন নাই, Nazis (জার্মান ওয়ার্কার) যারা হিটলারকে অপছন্দ করত, কালো রংয়ের মানুষ বা হালকা কালো (ইন্ডিয়ান, রোমানিয়ান), homosexual এবং মানষিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গদেরও মেরেছিলেন নির্বিচারে। হিটলার মনে করতঃ এরাই দেশের বোঝা, বোঝা কমাতেই তাদেরকে হত্যাকরা হত হলোকাষ্টে। ট্যুারে এসে সামান্য হিষ্টরিক্যাল জ্ঞান অর্জন হল, এটাই বা কম কি?
এখন খুদা লাগছে, খাব বলে জার্মান হোটেলে গেলাম। ছোট একটা সেন্ডউইচ খেয়ে কিছু ছবি তুললাম। ঘুম পাচ্ছিল তাই একটা ডবল এক্সেপ্রেসো এবং এক বোতল পানি নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের যাত্রা দিগন্ত প্রাগ, চেক রিপাবলিক।
আমরা প্রাগ-এ এসে পৌঁছালাম বেলা ৪:৩০ মিনিটের দিকে। সুন্দর পুরোনো শহর, কিছু বাড়ি ৮০০ বছরেরও পুরোনো। কিছু যুদ্ধে বিদ্ধস্ত। চেক রিপাবলিকের জনগন বেশিভাগই যিউস। সেই হিসাবে জার্মানরা তাদের উপর প্রচন্ড অত্যাচার চালিয়েছে। প্রাগ সুন্দর শহর হলেও জীবনমান অন্যান্য ইউরোপিয়েন দেশের চাইতে নিচে অবস্থান করছে। এখানে অনেক গরীবের দেখা মিলবে, যারা দিনে আনে দিনে খায়। শহরটি অনেক সুন্দর, প্রাগৈতাহিসিক দালানগুলো এখোনো ইতিহাস স্বাক্ষী রেখে বেঁচে আছে। প্রাগে সব কিছু ইউরোপীয়ন চ্যানেলের তুলনায় ২ গুন সস্তা। একযুগের কিছু সময় ধরে প্রাগকে ইইউ এর অন্তভূর্ক্ত করা হয়। এর আগে জার্মান এবং অন্যান্যদেশের সাথে তাদের বর্ডার পাসিং ইমিগ্রেশন সিষ্টেম ছিল। এখানে একটি কথা বলা দরকার, আমি লন্ডনে নামার পর একবার শুধুমাত্র পার্সপোর্ট পেক করা হয়েছে। এই দেশগুলো ঘুরতে পার্সপোর্ট চেক করার প্রয়োজন পড়েনি। প্রতিটি বর্ডার ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের প্রধান সড়কের মত জোড়া লাগানো, নাই কোন ইমিগ্রেশণ। প্রাগের ট্যুরিষ্টের সংখ্যা অন্যান্য ইউরোপিয়ান শহরের তুলনায় বেশি। কারণ এখানে খরচ কম জীবন যাপনের। প্রাগের ইতিহাস সম্পর্কে আমি কাল লিখব।
প্রাগ, চেক রিপালিক এসে হোটেলে উঠলাম। শৌচালয় সেরে বেড়িয়ে পড়লাম মেট্রোষ্টেশনের দিকে। এখানকার মেট্রো ষ্টেশনে টিকেট কাটা ছাড়া ঢুকার সুযোগ আছে। কোন পুলিশ নাই মেট্রোষ্টেশনে, কোন ব্যারিয়ার নাই টিকেট চেকিংয়ের। তারপরও মোটামুটি সবাই টিকেট কেনে। আমার মনে হয়ে এই দেশে কমিউনিষ্ট পার্টির প্রকোপ এখনো বিদ্ধমান। যাদের টাকা আছে, তারা টিকেট কিনবে, যাদের টিকেট কেনার সামর্থ্য নাই তারা না কিনলেই চলে। এই রকম হয়ত কোন নিয়ম আছে। টিকেট ছাড়া মেট্রোতে চড়া যায় জীবনে এই প্রথম অভিজ্ঞতা হল। তবে অবশ্যই আমরা টিকেট কিনেছিলাম।
আজ আমরা নতুন ট্যুরিষ্ট গাইডের সাথে প্রায় ১:৩০ মিনিট সময় কাটালাম। ছেলেটা দারুণ কথা বলতে পারে, প্রাগের ইতিহাস এইভাবে বলছিল যেন মনে হচ্ছিল আমার চোখের সামনে কোন একটি চলচিত্রের প্রজ্ঞাপন হচ্ছে। তার বলার ভঙ্গিমায় ছিল তেজ, সাথে শব্ধগুলো প্রতিটি উঁচু স্বরে বলছিল। আমি সব দেখছি, যুদ্ধ দেখছি, মানুষ মারা যাচ্ছে দেখছি, বক্তৃতা দেখছি। তার চোখগুলো জ্বল জ্বল করছিল, বুঝতে বাকি রইলো না, এ যুদ্ধ তার নিজের চোখে দেখা।
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরানো পর আমরা এলাম রেষ্টুরেন্টে। আমার এক পুরোনো পরিচিত বন্ধু আমাই বলেছিল। ইউরোপের কিছু শহর আছে; তুমি আমেরিকানদের মত খাবার অর্ডার দিয়ে খাবার পাবানা। ওরা ঝটপট খাবার পরিবেশন করে না। ইউরোপিয়াইন এই হোটেলগুলোতে যাবা সময় নিয়ে। কম পক্ষে ২-৩ ঘন্টা সময় তোমার দিতেই হবে। কোন ক্রজিন এর অর্ডার করা মানে তুমি শুধুমাত্র ঐ খাবারটাই খাচ্ছ তা কিন্তু নয়। তোমাকে আরো অনেক কিছু দিবে, যা তোমার গলর্ধ করণ করতে ২ ঘন্টা সময় লেগেই যাবে।
আজকে রেষ্টুরেন্ট এ ঠিক তেমনটি ঘটল। রাত ৮টায় আমরা রেষ্টুরেন্ট এ ডুকলাম, সূর্য্য এখনো আকাশে আছে। আগে থেকেই খাবার অর্ডার দেওয়া ছিলনা। তবে ৫০জন মানুষ বসারমত জায়গা আছে। রেষ্টুরেন্টটি ১৪৬৬ ইংরেজি সনের, গর্তের মধ্যে, সাদা মাটা একটি জায়গা। প্রথমে পাউরুটি এবং চিজ দিয়ে গেল, সাথে বিষ্কিট। একটু পর বিয়ার, যারা বিয়ার খায়না তাদের জন্য সাধারণ পানীয়। অনেক্ষন পর কিছু সালাদ সহ মাংসের ষ্টিক নিয়ে আসল, যেটা একটু ধোঁয়ায় পোড়ানো, এটা শেষ করতেই পেট ভরে গেল। মনে হচ্ছিল আর খেতে পারবনা। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে একটা মেনু নিয়ে এসে আবার খাবার অর্ডার নিল। কাঙ্গক্ষিত খাবার এল ১০ মিনিটের মধ্যে। এই খাবার শেষ করতে সময় লাগল ২০ মিনিটেরও বেশি। খাচ্ছি আর টেবিলের সবার সাথে আড্ডা চলছে। এ এক অন্য জগত মনে হচ্ছিল। সবাই সবার সাথে মনখুলে কথা বলছে, আমার মধ্যে থেকেও জড়তা হারিয়ে গেল, আমিও মিশে গেলাম তাদের সাথে। খাওয়া শেষে মনে হল এবার যাব। কিন্তু ৫ মিনিট পর ডেজার্ট (আইসক্রিম, ক্রিম, সুইস সসেস এবং রুটির সাথে মিষ্টি রস মেশানো কিছু একটা)। অনেক ভাল স্বাধ ছিল সব খাবার গুলোতেই। এবার মনে হচ্ছিল যাব, দেখলাম ফল নিয়ে আসল। পুরো ২ ঘন্টা আমরা খাবার টেবিলের সাথেই ছিলাম, অবাক করার মত। আমি সব সময় খাবাই শেষ করি সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের মধ্যেই। যারা আমকে জানেন তাদের হয়ত ভাল ধারণা থাকবে। জীবনে এই প্রথম একটা টেবিলে এতক্ষন বসে খেলাম কোন বিরক্ত ছাড়ায়।
খাওয়া শেষ করে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। একটু সামান্য অফিসের কাজ আছে। এই পোষ্টটা শেষ করে অফিসের কাজে হাত দিব, তারপর লম্বা একটা ঘুম। কাল ৮টার আগে কোন কাজ নাই। প্রাগে কাল অনেকগুলো জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। সুস্থ থাকলে মোটামুটি সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হবে।
২৮ জুলাই ২০১৫ - Prague; Czech Republic এর দ্বীতিয় দিন।
সকাল ৮.১৫মিনিটে ঘুম থেকে উঠলাম। শৌচালয় সেরে, নাস্তা করলাম। নাস্তার বিবরণ দেওয়ার কিছুই নাই। সেই ইউরোপীয়ন নাস্তা, তবে এখনো গতকাল রাতের খাবার পেট থেকে নামে নায়। আজ আমরা প্রাগের অনেকগুলো জায়গা ঘুরবো; তাই হালকা কাপড় পড়লাম, সেন্ডেল ছিল, যেন হাঁটার আনন্দ উপভোগ করতে পারি।
গাইড আসল, আমাদের সাথে নিয়ে পাতাল ট্রেনের মধ্যে গেল। টিকেট নিলাম শুধু একটা। এখানে এখনো কমিউনিজমের প্রাকটিস চলছে। তাই কিছু সুবিধা অন্যান্য ইউরোপীয়ান দেশের চাইতে এদেশে একটু বেশি। এদেশে ট্রাসপোর্টেশনের খরচ কম। তাই খাবার থেকে শুরু করে সব সস্তা। খুব সস্তা বলা যাবে না, আমি শুধু অন্যান্য ইউরোপীয়ান শহরগুলোর সাথে তুলনা করছি। পাতাল রেল থেকে বের হলাম উঠলাম ট্রামে, ট্রামে কোন টিকেট কাটতে হয়নায়, আমাদের টিকেটটা ৪৫ মিনিট ধরে যে কোন পরিবহন ব্যবহার সুযোগ দিবে, সেটা হোক এক বার অথবা শতবার।
প্রাগ কমিউনিজমের উদারহরণ স্বরুপ, ট্রেনের বা যেকোন পাবলিক ট্রাসপোর্টেশনে টিকেট কেনা যায়, তবে বাধ্যবাধকতা নেই। যার টাকা আছে সে কিনবে এবং কিনতে বাধ্য, যার টাকা নাই, সে বিনা টিকেটে যেকোন পাবলিক ট্রাসপোর্টেশন ব্যবহার করতে পারবে। আমরা ট্রাম থেকে নেমে প্রাগ ক্যাসেল (প্রাসাধ) এর দিকে রওনা দিলাম। সেই সুন্দর একটা প্রাসাধ। এটি দেখে মনে হয় খুব নতুন একটা প্রাসাধ, কিন্তু এটি ৮৭০সাল থেকে তেরী হচ্ছিল। বিভিন্ন রাজা, রানী এসে এই প্রাসাধের ধরণ পাল্টেছে, রুপ পাল্টেছে।
প্রাগ এবং চেক রিপাবলিকের ইতিহাসের দিকে আমি যাবনা। আমার মাথা ঘুরাই গেছে প্রাগের ইতিহাস শুনতে শুনতে। চেক রিপাবলিক ২৫ বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে এবং তা উপভোগ করছে। এর আগে কমিনিষ্টিদের অধিকারে ছিল চেক রিপাবলিক। রাজা প্রজাদের চাবুক মেরে কাজ আদায় করে নিত, পরে প্রজারা (খেটে খাওয়া মানুষ) বুদ্ধিজীবিদের কোণঠাসা করে সরকার চালিয়েছে। আজ চেক সম্পুর্ণ স্বাধীন একটা দেশ। কিছু গনতন্ত্র, কিছু সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রাগের বেড়ে চলা।
প্রাগে মানী এক্সচেঞ্জগুলো মোটামুটি বড় মাপের খচ্চর। বোর্ডে লিখে রাখে একরকম এবং বাস্তবে দেয় অন্য রকম। আমি যখন একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম বোর্ডে একরকম আর তুমি আমায় দিতে চাচ্ছ অন্য রকম; এটা কেন করছ? সে আমায় যা বলল তাতে মাথায় আগুন ধরে গেল। দুবাই অথবা দেশে হলে হয়ত কানের নিচে দিতাম। বাধ্য হয়ে খরচের জন্য ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা উঠাতে হল। চেক রিপাবলিকের টাকার নাম ক্রোনা।
আমাদের গাইড এখানকার স্থানীয়, বয়স ৪৫ বছরের কাছাকাছি হবে। সে নিজের একটা গল্প বলল। উনি যখন ছোট ছিলেন তখন প্রাগে কোন দামী কাপড় পড়া যেতটা, কোন দেশ ঘুরা যেতনা, নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্যকোন ভাষা শিখার সুযোগ ছিলনা। জার্মানী তাদের পাশের দেশ, সেখানে খুব ভালভাল কাপড় পাওয়া যেত, পাওয়া যেত ভাল জুতা কিন্তু দাম ছিল স্বাধের মধ্যে। যারা জার্মানী কাজে যেত, তারা জার্মানী থেকে কাপড় শরীরে পরে তারপর নিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে কাপড়গুলোকে মুচড়িয়ে পুরানো কাপড়ের মত করতে হত নইলে বর্ডারে কাপড় খুলে খালি গায়ে দেশে ঢুকাতো। কমিউনিষ্টরা খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ছিল এবং বুদ্ধিজীবিদের বিপক্ষে ছিল। খেটে খাওয়া মানুষগুলো কমিউনিষ্ট করত এবং তারা সব সময় বুদ্ধিজীবিদের চাপে রাখতো। তারা বুদ্ধিমান মানুষদের ভয় পেত তাই, সমস্ত সুবিধা বঞ্চিত করত। চেক রিপাবিলিকের প্রায় সব শহরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো কমিউনিষ্টদের হলোগ্রামের ছবি বিভিন্নভাবে টাঙ্গানো আছে।
চেক রিপাবলিক-এর একজন খ্যাত নামা মানুষের গল্প না বললেই নয়। Sir Nicholas Winton – ইংল্যান্ডের অধিবাসী, আজ চেক রিপাবলিকের হিরো। চেকস্লোভাকিয়া (পুরোনো নাম চেক রিপাবলিকের) থেকে ৬৬৯জন যিউস বাচ্চাকে ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের সময় বাঁচিয়ে লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্যার নিকোলাস বিদেশ ভ্রমনে বের হচ্ছিলেন, একজন চেক বন্ধু তার কাছে খবর পাঠান যে, যুদ্ধে সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। পারলে তাদের সহযোগীতা করতে। স্যার নিকোলাস সব কিছু ছেড়ে চেক এ চলে আসেন, তখন খুব খারাপ অবস্থা, তিনি বুঝতে পারলেন লাখ লাখ মানুষকে বাঁচানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে শিশুদের বাঁচানোর একটা কৌশল বের করলেন। তিনি ইংল্যান্ডে পত্রিকায় একটি খবর ছাপালেন এই বলে; যুদ্ধ পর্যোদুস্থ চেক-এর শিশুরা অসহায়, তাদের ইংল্যান্ডে নিয়ে রাখতে চাই, যখন যুদ্ধ শেষ হবে তাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কেউ তাদের দত্তক নিতে চাইলে ৫০ পাউন্ড করে পাঠাতে বলেছেন। যেন তাদের পরিবহণের জন্য সহায়তা করা যায়। তৎক্ষনাত ১,০০০ জনের উপর ইংল্যান্ডবাসী নিকোলাসকে পাউন্ড পাঠিয়েছিল এবং বাচ্চাদের দত্তক নেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু নিকোলাস শুধুমাত্র ৬৬৯জন বাঁচ্চাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হতে সময় লেগেছিল ৫০ বছর। সব বাচ্চা বড় হয়ে গেছে বুড়িয়ে যাচ্ছিল অনেকে। কারো যুদ্ধের কথা মনে নাই। নিকোলাসের চেক বন্ধুর কাছে সব বাচ্চাদের ঠিকানা ছিল। তিনি একদিন সবাইকে খাবারের নিমন্ত্রন দিলেন এবং নিকোলাসকেও ডাকলেন। সবাইকে অনুরোধ করলেন যেন তারা অবশ্যই এই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে, সবার জন্য সারপ্রাইজ আছে। সবাই এসেছিল, তখন তাদের সেই সারপ্রাইজ পার্টিতে নিকোলাসের অবদানের কথা বলা হয়েছিল। সেই দিন থেকে নিকোলাসের নামের পার্শ্বে স্যার শব্দটি বসে। সত্যেই অনেক বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন। উনি দৈর্ঘ্য ১০৫ বৎসর জীবন পেয়েছিলেন। এই ধরণের মানুষের হাজার বছর বাঁচা উচিত।
প্রাসাদ ঘুরে আমরা অনেকগুলো ছবি উঠালাম। তারপর ওল্ড টাউনে খেলাম।
আমি পৃথিবীতে দুটি জীনিসকে আমি দারুন ভয় পাই। একটা হচ্ছে সাপ, অন্যটা জোঁক। যারা গ্রামে থেকেছেন তাদের ধারণা আছে জোঁক কি জিনিস।
আমি একটু হাঁটছিলাম ওল্ড টাউন স্কয়ারে, দেখছিলাম বিভিন্ন খেলা, গান, বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সারা শহরটা জেন একটা সার্কাস। আমার সামনেই দেখছিলাম ৭-৮টা অজগর সাপ নিয়ে কিছু লোক খেলা করছে। আমি কাছে গেলাম শুধু ছবি উঠাবো উদ্দেশ্যে। কিন্তু হল বিপত্তি, একজন এসে আমার ঘাড়ে সাপ দিয়ে বলল তোমার ক্যামারা দাও। সে নিয়ে বেশ কটি ছবি উঠাল। ততক্ষণে আমার শরীরের রক্ত হিম হতে শুরু করেছে। তারপর সাহসিকতার সাথে কয়েকটি ছবি উঠিয়ে তবেই সাপটা ফেরতৎ দিলাম। আমি যে সাপটা কাঁধে নিয়েছিলাম এটাই সবচেয়ে ছোট সাপ। বাকী সাপ গুলো অনেক বড়সড়, প্রায় দুজন লাগে আলগাতে। ভয়ের কারণও আছে, আমি সাপের মাথাটা যতই দূরে রাখার চেষ্ঠা করছিলাম ততই এটা আমার মাথার দিকে চলে আসছিল। সাপের শরীরের চামড়াটা ইলিশ মাছের আশের মত কিন্তু ভিতর থেকে সাংঘাতিক শক্ত। একটা ভাল এবং ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হল।
তারপর ঘুরতে ঘুরতে হোটেল রুমে এসে বিশ্রাম নিলাম। আজ রাতে একটা পার্টি ছিল। সবাই অনেক আনন্দ করেছি। খেয়েছি মন ভরে, আজকেও দুপুর এবং রাতের খাবার সময় লেগেছে প্রতিবার ২ ঘন্টা করে। এখানে একমাস থাকলে ওজন ৫০ কেজি বেড়ে যাবে। পালাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি ওজন না বাড়াতে চাইলে। আমরা কাল প্রাগ, চেকরিপাবলিক ছাড়ছি।