Rhine Valley Germany
২৬ জুলাই ২০১৫ - Amsterdam Netherlands এর দ্বীতিয় দিন এবং শেষ দিন, Rhine Valley Germany আজ প্রথম দিন।
গতকালের লেখা শেষে ফেইবুকে পোষ্ট দেওয়ার পর ঘুমাতে যাব, এই সময় এক বন্ধু তার সাথে রাতের রেডলাইট ড্রিষ্টিক (Red light district) দেখার জন্য অনুরোধ করল। তখন বাজে ১টা, বেচারা একা থাকায় নিষেধ করতে পারলামনা। আমরা যে হোটেলে থাকি তার নাম হ্যামটন হোটেল, এই হোটেল থেকে রেডলাইট ডিষ্টিকের দূরত্ব ট্রেনে ২০মিনিট। রাতের রেডলাইট সত্যিই রেড। লালবাতীতে উজ্জ্বল রাতের রেড লাইট ড্রিষ্টিক। এটি একটা বাজার, এই বাজারে মানুষের আনাগোনা বাড়ে রাত ১২টার পর। যত গভীর হয় রাত তত বেশি লোক সমাগম ঘটে। রাতে অনেকক্ষণ ঘুরলাম, স্থানীয় কিছু ছেলেদের সাথে কথা বললাম। ওদের সাথে কফিহাউজে আড্ডা দিলাম ঘন্টা খানেক। নতুন আরো কিছু জানতে পারলাম।
আজকের পোষ্টে আমি আরেকটু বিবরণ দিব রেড লাইট ড্রিষ্টিক সম্পর্কে। থাকবে ইউন্ট (Windmill) মিল এবং চিস্ ফার্মের (cheese farm) কথা।
রেডলাইট ডিষ্ট্রিকে সেক্স ইন দ্যা সিটি নামে একটি দোকান আছে, যেখানটায় যৌন পন্য সামগ্রী পাওয়া যায়। আমরা বাঙ্গালীরা যৌন পণ্য বলতে বুঝি কনডম এবং কিছু ভ্রায়েগ্রা (যৌন উদ্দেপক)। এখানে সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম, এই দোকানটিতে রাবারের পুতুল পাওয়া যায়, রোবোটিক পুতুল পাওয়া যায়। যৌন উদ্দিপনার জন্য যৌনদ্দিপক খেলনা কিনতে পাওয়া যায়। পিপ বার (Pip Bur) নামে এখানে থিয়েটার আছে, যেখানে যৌনতাকে জীবন্ত সমনা সামনি দেখা যায়। এখানে গ্যা জুটি অথবা ষ্ট্রেট জুটি দর্শদের সামনে সরাসরি লাইভ সেক্স সৌ দেখায় কোন জড়তা ছাড়ায়। যৌনতা যদিও একটি Privet বিষয়, এখানে Privet বিষয়গুলোকে Public দেখায়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এটাও একধরণের যৌনউদ্দেপনার অংশ হিসাবে কাজ করে। এই সৌতে ডুকতে ২ ইউরো জমা দিতে হবে।
রাস্তায় মাতালের ছড়াছড়ি, বিভিন্ন বেসুরা গায়কের গান কানে ভেসে আসে। কিছু দূরে কয়েকজন মিলে গানের ছোট লাইভ সৌ করছে। নারী দেহ ব্যবসায়ীরা প্রনোদনা মূলক আচরণ করছে। বিশ্বাস হচ্ছিলনা, এ ধরণের পরিবেশ বা জায়গা পৃথিবীতে থাকতে পারে। বাস্তবে এই রকম খোলামেলা পরিবেশের একটি জায়গা থাকতে পারে নিজেকে বিশ্বাস করাতে সময় লেগেছে। রাস্তার পাশে পুলিশের অবস্থান দেখলামনা। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগল, কোন পুলিশ নাই, কোন নিরাপত্তা কর্মী নায়। অটোমেটেট মেশিনের খেলনার মতো বাজারের পরিবেশ মনে হচ্ছিল।
এখানে গ্যা’বার গুলো ফানি/ফাঙ্কি দেখাচ্ছিল। সহজে বারগুলো চেনার জন্য একটি সিম্বল যথেষ্ঠ, রংধনুর পতাকা। প্রতিটা গ্যা বারের সামনে রংঘনুর পতাকা। বারেক ওবামার সরকার সম্ভবতঃ এই সিম্বলটি এখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে এখানে গ্যাদের বড় একটা অনুষ্ঠান আছে। গ্যা’দের জন্য নির্ধারীত জায়গা এবং পোশাক বরাদ্ধ আছে। ঐ দিনগুলোতে কোন স্বাভাবিক মানুষ ঐ পথ মাড়ালে তাকে গ্যা’দের পোশাক পড়েই ঐ এলাকা থেকে বের হতে হবে।
এখানে সবার চোখের রং ফেকাসে, উদ্ভাস্তের মত ঘোরাঘুরি করতে দেখছি বেশির ভাগ মানুষকে। কারো সাথে কেউ কথা বলছে না। যে যার আপন মনে চলছে। এখানেও ঈগল গ্রুপের মত মটর সাইকেলের বহর যাচ্ছিল, রাউডি টাইপের লোকগুলো। মনে হচ্ছিল ভয়ংকর কোন আচরণ করবে, মানুষগুলো অনেক মজার ছিল। তারা দল বেঁধে ঘোরাঘুরি এবং রাস্তায় থাকা মানুষগুলোর খবর নিচ্ছিল।
রাস্তায় হেঁটে চলতে চলতে দেখছিলাম সাইকেলের বিভিন্ন পার্কিং ষ্টেশণ, লন্ডনের মত নয়। সব সাইকেলগুলো ব্যক্তিগত। এই শহরে যদি ১০ হাজার লোক বসবাস করে ৯ হাজারের কাছেই সাইকেল আছে। সবাই সাইকেল ব্যবহার করে প্রত্যাহিক কাজে। নেদারল্যান্ডের রাস্তাগুলো ছিমছাম, স্বপ্নের মত। দুবাইয়ে রাস্তাগুলো দারুণ প্রশস্ত এবং ২৪ ঘন্টা রাস্তায় গাড়ি থাকে। এখানকার হাইওয়ে ছাড়া খুব একটা জ্যাম কোথাও চোখে পড়লনা। শহরের ভিতরের রাস্তাগুলো যেমন ছিমছাম, তেমনি বাড়িগুলো দেখতে অনেক মনোমুগ্ধকর। প্রতিটি বাড়ি ৪-৫ তলা বিশিষ্ট, একটার সাথে অন্যটা লাগানো। সামনে একটু খানী বাগান, সাথে আছে বসার জায়গা এবং ছোট একটি গাড়ী পার্কিং এর জায়গা। বড় হাইওয়ের পাশে অবশ্যা বড় বড় বিল্ডিং আছে। ব্যবসায়ীক ভবনগুলো ব্যাক্তি মালীকানাধীন ভবনের মধ্যেকার দূরত্ব বজায়ে বানানো হয়েছে।
প্রায় ২টার দিকে রুমে ফিরলাম। অনেক ক্লান্ত ছিলাম, সারাদিনের ঘোরাঘুরির কারণে বিছানায় পড়া মাত্রই নগদে ঘুম।
ভোর ৬:৩০ মিনিটে এলার্মে ঘুম ভাঙ্গল। আমার রুম পার্টনার শ্রীলঙ্কান, ব্যাটা ফটোগ্রাফার, বয়স ২৭, কম কথা বলে, থাকে অষ্ট্রেলিয়াতে। মানুষ হিসাবে ভালই মনে হল। আমি স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম, কারণ রাতে এই হোটেলে পূনরায় ফিরছিনা। সকালের নাস্তা করলাম। বাসায় ফোন দিলাম, কিছু বন্ধু-বান্ধবকে ফোন দিয়ে কথা বলে গাড়িতে চেপে বসলাম। ৮:৩০ মিনিটে কোচ ছেড়ে দিল, ১৫মিনিটের মধ্যেই ইউন্ড মিলে এসে পৌঁছালাম। ইউন্ড মিলের একটা ছবি ষ্ট্রেটাসের সাথে যুক্ত করলাম। এই মেশিনগুলো হাতে বানানো এবং প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত এগুলোর ব্যবহার হয়ে আসছে। আমাদের দেশে পানি সেচের জন্য, পানীর পাম্প বসানো হয় অথবা মানুষ নিজে পানি সেচ দেয় ফসলী জমীতে। ইউরোপের এখন বেশিরভাগ জায়গায় আধুনিক ইউন্ড মিল আছে, যেগুলো ইসপাতের তৈরী। কিন্তু তাদের তৈরী গাছের ইউন্ড মিল হাতে গোনা কিছু শহরে।
ইউন্ডমিল দেখা শেষে আমরা গেলাম চিজ মেকিং ফার্মে। নেদারল্যান্ডে এখনো চিজ হাতে বানানো হয়। চিজ সম্পর্কে বলার আগে একটু ধরণা দিতে হবে চিজ্ জীনিসটা কি। অনেকে চেনেন, তারপরও যারা জানেন না শুধু তাদের জন্য। গাভীর দুধ ফাটিয়ে স্বর বানানো হয় মিষ্টি বানানোর জন্য। এখানে অনেকগুলো দুধের স্বর পানি সরানোর পাত্রে ৬-৮ ঘন্টা রাখার পর একটা শক্ত পিন্ডতে পরিনত হয়। তারপর শক্ত পিন্ডটি লবনের পানির মধ্যে ৬-৮ ঘন্টা চুবিয়ে রাখা হয়। আবার ৬-৭ ঘন্টা শুকাতে হয়। এর পর ৪-৫ দিন প্রিজারভেটিব লাগিয়ে শুকাতে হয়। তাজা স্বর একটু নরম হয়, বার্গার বা (cheese ball) এই চিজ ব্যবহার করা হয়। চিজ যত পুরোনো হয় তার স্বাধ ভাল এবং নোনতা হয়। সাধারণত ৫ বছর পর্যন্ত খোলা জায়গায় রেখে দেওয়া যায় এই চিজ্। ইউরোপীয়ানরা প্রচুর চিজ খায় কারণে অকারণে।
আমরা যে ফার্মে এসেছি সেটা ১৭০ বছরের পুরোনো। পৈত্রিক সূত্রে পরিবারটি ব্যবসাটি চালাচ্ছে ফার্মের মালিক। এদের ১১০টা গরু আছে এবং দিনে দুইবার দুধ দোহন করে। এই ফার্মে চিজের পাশাপাশি কাঠের জুতাও বানায়। কাঠের জুতা বানাতে কাঠগুলোর রকম আলাদা হয় এবং তাজা কাঠ ব্যবহার করতে হয়। মেশিনে জুতা বানাতে লাগে ২৫ মিনিট, পলিসিং সহ। হাতে বানাতে লাগে ৭ দিন। দেখলাম এখানকার একজন কর্মী কিভাবে জুতা বানায়। এই জুতাগুলোর ইতিহাস আছে। একটি ছেলে একটি মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় জুতা দিয়ে। মেয়েটি যদি জুতাগুলো গ্রহণ করে তবে বুঝতে হবে মেয়েটি বিয়েতে রাজী এবং বিয়ের দিন ঐ জুতো গুলিই মেয়েরা পড়ে। গাছের জুতার অন্যান্য ব্যবহার হচ্ছে বাগানে কাজ করা। গরমের সময় মানুষের গায়ের সারা ঘাম গাছের জুতা টেনে নেয় এবং শীতে হালকা গরম অনুভূতি দেয়। তাই এখানকার কৃষকেরা এই জুতাগুলোই ব্যবহার করে।
ফার্মে ঘুরা ঘুরি সেরে আমরা যখন জামার্নীর দিকে যাচ্ছি তখন দুপুরের খাবারের বিরতী চলছে। কোচ (বাস) থামল পেট্রোল পাম্পে, আমরা খাবার অর্ডার দিলাম। খেয়ে শৌচালয়ের ডাকে গেলাম। বেঁধে দেওয়া সময়ের ৩মিনিট দেরি হল। আমাদের টিমের একটা নিয়ম আছে। কেউ দেরি করলেই গান গাইতে হবে। আমি দেরী করেছি, কিন্তু জীবনেও তো গান গাইনাই। যাই হোক রুলস এজ রুলস। তাই বাংলায় শুরু করলাম “সেই তারা ভরা রাতে, আমি পারিনি বুঝাতে”। যে কজন বাঙ্গালী ছিলেন তারাই বলতে পারবেন আমার গানটা কি ছিল। বাকিরা কিচ্ছু না বোঝাই এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। যারা বাঙ্গালী আছে সাবাসি দিচ্ছিল, বুঝলাম গান ভাল হয়নাই, আমাকে অসন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য তাদের ছলনা, আর আমরা আমরাইতো, খারাপ গাইলেও বলার কিছু নায়। হা হা হা...
আমরা প্রায় ৩:৩০মিনিটের দিকে Rhine Velly Germany পৌঁছালাম। আসতে আসতে মনোরম দৃশ্য। বেলজিয়াম এর উপর দিয়ে নেদারল্যান্ড এ গেলাম কোথাও তেমন বড় কোন পাহাড় চোখে পড়ে নায়। জার্মানীর রাইন ভেলীর কাছেই আসতে বিশাল বিশাল পাহাড়, সবুজে ঘেরা ১৫০ বছরের পুরানো প্রাসাদগুলো চোখে পড়ল। যেমন আবহাওয়াও তেমনি যাচ্ছে তা সুন্দর শহর। এখানে আসার সাথে সাথে মনে হতে লাগল আর ফিরে না যাই। যারা নীল গীরিতে ঘুরে এসেছেন তারা একটু আঁচ করতে পারবেন পাহাড়গুলো কত সুন্দর। পরিপাটি রাস্তা, বাসটা সাবধানে চালাতে দেখলাম। পাহাড়ের সাথে নদীটা ৬টা দেশের মধ্যে খানী বয়ে গেছে। ইউরোপের সব চেয়ে বড় নদী এইটা। এই নদী যেমন পর্যটকদের মনো রঞ্জন করে তেমনি মালামাল পরিবহনের কাজেও ব্যবহার হয়। বড় বড় জাহাজ নদীর উপর মালামাল বয়ে নিতে দেখলাম। বাস থেকে নেমে কিছু ছবি উঠালাম। কিছুক্ষণ পর জাহাজ এলো নদীর পাড়ের জায়গা গুলো ঘুরে দেখাতে। প্রায় ঘন্টা খানেক ছিলাম জাহাজে। তারপর হোটেলে উঠলাম, ছোট ছোট ৩তলা বিল্ডিং, অনেক বছরের পুরোনো, কিন্তু ভেতর থেকে এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রতিটা বিল্ডিং-এর অভ্যন্তরে আধুনিকতার ছোঁয়া। ৭:৩০মিঃ রাতের খাবার খেলাম, সাথে আমাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ কেরোকিতে গান করছিল। এখন অনের বেশি ক্লান্ত লাগছে, গত রাতে ঘুমটাকে পুষিয়ে নিতে হবে।
কাল সকালে নতুন জায়গা ঘুরতে যাব। টিম লিডার থেকে একটি টাইম কার্ড পেয়েছি, কাল দিনের বেলা কোথায় কোথায় যাওয়া হবে সেখানে উল্লেখ করা আছে। তবুও ইচ্ছে করছেনা কার্ডটা খুলে পড়ার জন্য।
ঘুমাই পড়লাম।