Amsterdam Netherlands
২৫ জুলাই ২০১৫ - তৃতীয় এবং শেষ দিনের London সকাল, Amsterdam Netherlands এর প্রথম দিন-
ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠলাম, মনে হচ্ছিল পর্যাপ্ত ঘুম হয়েছে। স্নান সেরে, ব্যাগগুলো আরেকবার চেক করে নিলাম। দেখছিলাম বারংবার কোন প্রয়োজনীয় জীনিস ফেলে যাচ্ছি কিনা। বিশেষ করে পার্সপোট, মোবাইল ফোন আর মানিব্যাগ, ধারাবাহিকভাবে ৩ বার চেক করে নিলাম। হোটেল লবিতে এসে ইলেকট্রনিক চিপ (চাবি) জমা করলাম। রিসেপশনে এসে একটি টেক্সি ডাকার অনুরোধ করলাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে টেক্সি হাজির।
লন্ডন এর টেক্সি দুবাই/ইউই-এর মত সরকারের ব্যবস্থাপনায় চলছেনা। লন্ডনের স্থানীয় কমিউনিটি এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে, টেক্সিতে মিটার রিডিং দেখলাম না। মনে হল একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম ভাড়া আদায় করা হয়, সময় এবং সুযোগমত। শক্ত কোন নিয়েমর মধ্যে নাই। এখানে মাঝে মাঝে রিক্সা দেখতে পাওয়া যায়, শুধু বাঙ্গালীরাই এগুলো চালায়। কোন রেজিষ্টেশন নাই, নাই কোন দূর্ঘটনার ইনসুরেন্স।
ড্রাইভার এলেন, লাগেজ ঢুকালাম। জানতে পারলাম ড্রাইভার বাংলাদেশি (সিলেট)। বসবাস করছেন লন্ডনে ১৯৭৩ থেকে। আগে উনার রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা ছিল, এখন সুবিধা করতে পারছেননা তাই টেক্সি চালাচ্ছেন। পুরো ফ্যামিলি একই সাথে বসবাস করেন লন্ডনে। কোন এক প্রয়োজনে ড্রাইভারটি কল করছিলেন কল সেন্টারে এবং সিলেটি ভাষায় কথা শেষ করলেন। জানতে চাইলাম, কল সেন্টারে বাঙ্গালী আছে কিনা। ওনার কথায় অবাক হলাম, পুরো টেক্সি ট্রাফিকিং লন্ডনের ব্যবস্থাপনায় আছে বাঙ্গালী কমিউনিটি। টেক্সিটা ওনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শুধুমাত্র ইনসুরেন্স এবং একটা কমিউনিটির একটা খরচ দেওয়া লাগে। যাই হোক রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রীনউইচ ৩০-৪০ মিঃ ড্রাইভ ৪০ পাউন্ড গুনতে হল। টেক্সির গতি ছিল সর্বোচ্চ ৩০কিঃ, দুবাই এর সাথে তুলনায় কচ্ছপের গতি। টেক্সিভাড়া মনে হলো দুবাইয়ের ৫গুন বেশি। না হওয়ার কারণ দেখছিনা, পেট্রোল এর দাম লন্ডনে অনেক বেশি। তাছাড়া মাসুকতো আছেই। হলিডে ইনন এক্সপ্রেস, গ্রীনউচস এ পৌঁছালাম সকাল ৬টায়, অপেক্ষা করছিলাম আমাদের ট্যুর লিডারের। মনে হচ্ছিল কোথাও একটা সমস্যা হতে পারে, তাই একটা মাস্যাজ দিয়ে রাখলাম তার মোবাইলে। “ডিয়ার কারলী, শুভ সকাল, এক্সপেট এর ইমেইল থেকে জানতে পারলাম তুমি আমাদের ট্যুর লিডার। তোমার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখছি আমি হলিডে ইনন এক্সপ্রেস গ্রীনউচস এ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সকালে তোমায় ফোন করে বিরক্ত করলামনা। ধন্যবাদ।” মিনিট দুই এর মধ্যেই ফিরতি মেসেজ এল লেখা “হ্যাল পল্, শুভ সকাল, আমি জেগে আছি তোমাদের একত্র করতে, দয়া করে অপেক্ষা কর, ৭:১৫ মিঃ আমি তোমাকে হোটেল লবি থেকে উঠিয়ে নিব।” ৭:১০মিঃ সরাসরি কল দিল কারলী, অনুরোধ করছিল নিচে নেমে আসার জন্য, ট্যুর বাস অপেক্ষা করছে আমার জন্য। প্রফেশনাল মনে হল।
আমরা আজ আমাস্তদাম যাচ্ছি, ন্যাদারল্যান্ড-এ। ফ্রান্স বর্ডার পাস করেই ব্যালজিয়ামের উপর দিতে যেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে নদী; ফেরির মাধ্যেমে। আবহাওয়া দারুণ ১৮ ডিগ্রি। ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। চায়না, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশী, আফ্রিকান, শ্রীলকাংন, ইউরোপীয়ান, অষ্ট্রেলিয়ান এবং ইউএস সহ বিভিন্ন দেশের পুরো ৫০জন সদস্যের সাথে ট্যুরে অংশগ্রহণ করলাম। অনেকে এই ট্যুর ২-৩ বার আগেও ঘুরে এসেছেন, আবার অনেকে একদম নতুন; আমার মত। কেউ এসেছে পরিবার নিয়ে, কেউবা একা একটু প্রশান্তির ছৌয়ার জন্য। লন্ডন শহর থেকে বর্ডার আসতে ১ ঘন্টা লাগল কোচে, সেখানে প্রায় ৩০ মিনিট ট্রাফিক জ্যাম; তারপর ৩০ মিনিট বিরতির পর ফেরিতে এসে ঢুকল বাস। আমরা ডেকেতে এসে বসলাম। ৫ তারকা সুযোগ সুবিধা। কিছু ছবি নিলাম। বেশ ক’জনের সাথে পরিচয় হল। দেড়ঘন্টা লাগল ফেরি পারাপারে। গাড়িতে (কোচ) এসে বসলাম। বর্ডার ক্রস করতেই হাতের বামপাশে জানালাই চোখ আটকে গেল। হাজার হাজার বস্তি। আফ্রিকা সহ বিভিন্ন সুবিধা বঞ্চিত এলাকার মানুষগুলো এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। বস্তিগুলো কালো পলিথিন দিয়ে ঘেরা। আমাদের দেশে টেকনাফের মত অনেকটা। বেশি কিছু দেখার আগেই বাস অনেকদূর এগিয়ে গেল। হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে।
ব্যালজিয়াম এর দুধারেই হেকটররের পর হেকটর গম/ভুট্টার বাগান দেখা যাচ্ছে। খুব দূরে সবুজের মাঠ। বুঝতে পারছিনা কি চাষ হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে প্রচুর কৃষিজাত পণ্য, উৎপাদনশীল দেশ। ট্রান্সপোর্টের জন্য বিমান ব্যবহার করলে হয়ত একটি দেশ সম্পর্কে এতটুকুও জানতে পারতাম না। যদিও আমার জানা, সময় এবং জ্ঞান সীমিত।
গতকাল লন্ডনের শৌচালয় সম্পর্কে বলেছিলাম। এখন দেখছি ইউরোপের এই শহরটির শৌচালয়েরও একই অবস্থা। তার মানে এই হল আমাকে অনেক ভুক্তে হবে শৌচালয় নিয়ে। তাছাড়া নতুন একটি ব্যাপার লক্ষ করলাম। প্রতিটি শৌচাগারের দরজা খোলা থাকে। আমি মনে করেছিলাম লন্ডনের ঐ হোটেলটির দরজায় তালা লাগাতে ভুলে গেছে। ইউরোপীয় কালচার, কেউ কার অনুমুতি ছাড়া দরজা হালকা লাগানো ঘরে প্রবেশ করেনা, এমনকি বাসায় তালা না থাকলেও। বাংলাদেশীরা অনুমুতির ধারধারিনা, তাই দরজায় তালার ব্যবস্থা করতে হয়।
লন্ডনের রাস্তার গাড়ির চলমান পথ হাতের বাম পাশে থাকে ঠিক আমাদের দেশের মতই স্টিয়ারিং থাকে। দুবাইতে ঠিক উল্টা। ন্যাদারল্যান্ডেও দুবাইয়ের মত ডান দিক থেকে ষ্টিয়ারিং। পাশাপাশি দুটো দেশ দুইরকম নিয়ম মেনে চলছে। প্রতিদিন লোক আসা যাওয়া করছে তাদের নিজেরদের ষ্টিয়ারিং স্টাইলে কোন সমস্যা হয়না।
আজ বেশ কটি জায়গা ঘুরে দেখা হল। আমরা আমাস্তাদাম পৌঁছালাম বিকাল ৫:৩০মিনিটে। হোটেলে তাড়াতাড়ি নিজের কাপড় রেখে আবার বাসে চড়ে বসলাম কিছু বিশেষ জায়গা দেখবো বলে।
রেডলাইট ড্রিষ্টিক- এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েগুলো দেহ ব্যাবসা করছে। প্রতিটা বিল্ডিংয়ে ১০-১২ টা রুম, প্রতিটা রুমের বাইরে গ্লাস লাগানো, সাথে একটি লাল টিউব লাইট লাগানো। প্রতিটি মেয়ে দরজার কাছে এসে কম বসনা হয়ে ক্রেতাদের সাথে দর কষা-কষি করে। সাধারণতঃ ৩৫-৫০ ইউরোতে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সঙ্গের জন্য গ্রাহকে এ্ই মাশুল গুনতে হয়। সব মেয়েরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারীনি। প্রতিটা মেয়ের মেডিকেল সার্টিফিকেট দরজায় টাঙ্গানো। প্রতিদিন তাদের মেডিকেল সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। স্থানীয়দের মুখের কথা, বেশির ভাগ মেয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য এই পেশা বেছে নিয়েছে। কিছু সৌখিন মহিলা আছে, যাদের টাকা এবং দেহের চাহিদা দুটোর কথাই ভেবেই এই ব্যবসা করছে। রেডলাইট ড্রিষ্টিকে চলার পথে কোন মেয়েকে দেখে ভিডিও তোলা, ছবি তোলা এবং খারাপ উক্তি করা যাবেনা। এর একটিও করলে কপালে খারাপ আছে, আমার সামনেই একজনের মুখে গ্লাস ভর্তি পানি মেরে সারা কাপড় ভিজিয়ে দিল।
এখানে দুইটি ব্যবসা বৈধ করেছে সরকার। একটা দেহ ব্যবসা, অন্যটা গাজা (মারিজুয়ানা) বিক্রি এবং সেবন। গাজা এখানকার প্রতিটা কফিহাউজে পাওয়া যায়। এখানে বিভিন্ন ফ্লেভারের গাজার পুড়ি পাওয়া যায়, প্রতিটা পুড়ি ৫ ইউরো। আমি কোন মাদক পছন্দ করিনা। তবুও সখের বসে বন্ধুদের সাথে ১টা ব্যবহার করে দেখলাম। আমার ফ্লেবারটা ছিল হালকা, তাই তেমন কোন অসুবিধা বোধ করছিনা এখনো। ন্যাদারল্যান্ডের সরকার একটা সময় যখন মাদকের প্রকোপে পড়ে তখন গাজাটা বৈধ করে বাকি মাদক নিষিদ্ধ করে। অবশ্য এর সুযোগ ভোগ করছে ন্যাদারল্যান্ড। মাদকের মধ্যে গাজা ছাড়া বাকি আর তেমন কিছুই পাওয়া যায়না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ডকুমেন্টরি বানাচ্ছে গাজাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। গাজার একটা বিশাল বাজার আছে আন্তজাতীক বাজারে। আমার বিশ্বাস এই ডকুমেন্টরি করছে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য, ট্রেডিং পলিসি।
রাস্তায় চলার সময় পানির মাঝখানে স্থাপিত চায়না রেষ্টুরেন্ট চোখে পড়ল। এটি একটি চায়নার অভিজাত রেষ্টুরেন্টের ১০০% খাটি ডুপ্লিকেট কপি করে বানানো হয়েছে। এমন কি, আসন সংখ্যা থেকে শুরু করে পানি কল পযর্ন্ত একই রকম। এই রেস্টুরেন্টটি উদ্ভোদনের সময় বড় অনুষ্ঠান করা হয়েছিল এবং স্থানীয় ডাচদের আমন্ত্রন করা হয়েছিল। তখনই বাঁধল বিপত্তি। চাইনা মানুষের সাধারণ গড়ন ছোট, আর ডাচরা পৃথিবীর দৃর্ঘাকৃতি মানুষের মধ্যে প্রথম। ঐ অনুষ্ঠানে কয়েকজন ডাচদেরই জায়গা হয়েছিল রেষ্টুরেন্টের অভ্যন্তরে, বাকীদের রেষ্টুরেন্টের বাইরে থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ডাচরা ব্যবহারে খুব নমণীয় এবং দেখতে খুবই সুন্দর। ইতিহাস বলে পৃথিবীতে ডাচেদের শারীরিক গড়ন আগে খুব বেশি ছোট ছিল। পরিবেশগত এবং খাবারের গুনগত মানের কারণে ডাচদের স্বাস্থের উন্নতি হয় এবং বিশ্বে প্রথম স্থানে অবস্থানে চলে আসে।
এখানে ঝাল মানুষ কম খায়, স্পাইস বললে চিনেনা। এখানকার মানুষ জানেনা, ভেজেটেরিয়ান কি জীনিস। তাই কেউ ডাচদের ভেজেটেরিয়ান খাবার বললেই অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। সব ধরণের মাংস এখানকার মানুষ খেতে পছন্দ করে। ডাচেদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার চিজ (দুধের স্বরের শক্ত এবং পুরোনো অংশ)। এখানকার রেষ্টুরেন্টে ডুকলেই টিপস আপনাকে দিতেই হবে, সেটাই ভদ্রতা। নাদিলে অবস্য কিছু বলেনা।
আজকে লঙক্রজ এ সন্ধ্যাটা কাটালাম এবং রাতের খাবার খেলাম। পিজা, সালাদ, আইসক্রিম এবং পানীয়। খাবারের মান হিসাবে খুব বেশি ব্যবধান অনুধাবন করি নাই। সবাই বলে এখানকার খাবারের স্বাধ ব্যাতিক্রম এবং ভালমানের।
কাল সারাদিন ঘোরাঘুরি। কালকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।