আমার দেখা ইউরোপ
ফেইসবুকে আমার দেখা ইউরোপ ট্রিপ নিয়ে প্রায় ১৪টি টাইম লাইনে লেখাসহ ছবি গিয়েছে। সব লেখা সবাই ঠিক মত ক্রমান্বয়ে পড়তে পারেননি। তাই ব্লগে পুরো ১১টি দেশের ইউরোপের ট্রিপ নিয়ে ভ্রমন কাহিনীটি যুক্ত করলাম যেটা মোট ৬২ পাতার।
![](https://static.wixstatic.com/media/8355e9_0083251824004ce89f893c3c318eb89d.jpg/v1/fill/w_980,h_649,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/8355e9_0083251824004ce89f893c3c318eb89d.jpg)
গত ২-৩ বছর থেকে ভাবছি একটা বড় ট্যুরে বের হব। মাঝে বেশ কয়েকবার ইস্তাম্বুলসহ আরো কয়েকটা দেশে যাওয়ার পরিকল্পনাছিল। অনেক বন্ধুদের নিমন্ত্রন করলাম ট্যুরগুলোতে অংশ গ্রহন করতে। সবাই বিভিন্ন সমস্যা দেখায়ে শেষ সময়ে শটকে পড়েছে। কাউকে দোষ দিচ্ছিনা, আমার বাস্তবতা আর অন্যদের বাস্তবতা হয়ত ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত ২টা বন্ধু রাজি হল আমার সাথে ইউরোপ ট্রিপে যোগ দিতে। একজন ছিল ইন্ডিয়ান আরেকজন পাকিস্তানী। আমি নিজে তাদের জন্য প্যাকেজ বুকিং দিলাম আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে। তাদের ভাল ভাবেই জানতাম, হয়ত ঠিক শেষ সময়ে ড্রামা করে বলবে যেতে পারবেনা। তারপর বুকিং দিলাম নিজের টাকা খরচ করে শুধু মাত্র যেন বলতে না পারে লেনিন তাদের সাহায্য করে নায়।
আমাদের ট্রিপটা লন্ডন থেকে শুরু হওয়ার কথা, তবে কারো ইংল্যান্ডের ভিসার সমস্যা থাকলে সরাসরি ন্যাদার ল্যান্ডে একই ট্যুরে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যুরটা লন্ডন থেকেই শুরু করব। সেক্ষেত্রে আমাকে ২টা ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। একটা ইংল্যান্ডের এবং অন্যটা সেঙ্গাইন (ফ্রান্স)। ট্যুরটা প্রোগ্রাম করছিলাম ৩ মাস আগে থেকে। মে মাসের শুরুতেই প্রথম সপ্তাহের শেষ দিন, মানে বৃহষ্পতিবার কাজের চাপ ছিলনা। রাত ১১টা খাওয়া শেষ করলাম, আমার মেয়েটাও ঘুমিয়ে গেছে।
আমার ব্যাক্তিগত কম্পিউটার, ক্রেডিট কার্ড, পার্সপোর্ট কপি সাথে নিয়ে বসলাম নিজের পড়ার টেবিলে। ইউ.কে অনলাইন ভিসাটা রাত্রেই শেষ করব। শুরু করলাম ফরম ভর্তি করা, প্রায় ২২ পাতার একটা অনলাইন ফরম পূরণ করতে সময় লাগল আনুমানিক ৩ ঘন্টা। মাঝে মধ্যে কিছু ভুল যে করিনি তা নয়, ফাইনাল সাবিমশন দেওয়ার আগে কমপক্ষে ৩ বার পড়ে দেখেছি ফরমগুলো। ঐ ফর্মে মোটামুটি আমার চৌদ্ধগুষ্টির তথ্য আদায় করে নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম লেগেছিল, আমি আগে কোন কোন দেশে গিয়েছিলাম এবং কত তারিখে, আমার বৌ বাচ্চার পাসপোর্ট ইতিহাস। ভাগ্যিইস আমার পুরো পার্সপোট ২টার কপি ড্রপবক্সে ছিল তাই সমস্যা হয় নায় তথ্যগুলো দিতে।
ফাইনাল সাবমিশন করলাম ক্রেডিট কার্ড ইনফরমেশন দিয়ে। আমাকে পুরো ২২ পাতার একটা পিডিএফ ফাইল পাঠালো। অনলাইনে সাক্ষাতের দিন ধার্য্য করলাম ৪ দিন পর। মে মাসের ৫ তারিখ আমার সাক্ষাতের সময়ছিল ইউকে এম্বেসিতে, ওয়াফি সেন্টার, ডুবাই। যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো সাথে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হল (অরজিনাল পার্সপোর্ট, ভ্যালিট ইউ.এ.ই ভিসা ৬ মাস, ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট এটাসষ্টেট বাই ব্যাংক, ছবি ৫ কপি, ইনসুরেন্স, নো অবজেকশন লেটার আমার কোম্পানী থেকে, ইনভাইটেশন লেটার, ট্রাবল ডকুমেন্ট- হোটেল বুকিং, কোথায় যাব, কত সময় থাকব, ফ্লাইট টিকেট ইত্যাদি)। সব রেডি করতে ২ দিন সময় লেগে গেল। পূর্বনির্ধারীত সময়ের মধ্যে সাক্ষাতের জন্য পৌঁছে গেলাম। লাইনে দাঁড়ালাম ৫ মিনিট টোকেন নেওয়ার জন্য, মিনিট ১৫ এর মধ্যে ডাক পড়ল। ভেতরে গেলাম, কাগজের ফাইলটা জমা করলাম, আমার ছবি নিল, ফিংগার প্রিন্ট নিল এর পর পেমেন্ট সেন্টারে পাঠাল অন্য কিছু বিল দেওয়ার জন্য। বাস শেষ। তার মানে সেখানে আমাকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়নি। একটু অবাক হলাম। আমাকে জানালো হল ১৫ ওর্য়াকিং ডে এর মধ্যে আমার পাসপোর্ট ভিসাসহ চলে আসবে যদি কোন সমস্যা না থাকে। ১৮ মে আমার পাসপোর্ট কুরিয়ারের মাধ্যমে পেলাম ৬ মাসের মাল্টিএন্ট্রি। খুশি লাগল, কোন সমস্যা ছাড়া ভিসাসহ পাসপোর্ট, তাও আবার কারো সহযোগীতা না নিয়ে। ওয়াও...
এখন দ্বীতিয় ধাপ পাড়ি দিতে হবে সেঙ্গাইন ফ্রান্স ভিসার জন্য। অনলাইনে সব তথ্য জোগাড় করলাম, ৩ পাতার একটা পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে পূরণ করলাম। সাথে একই ডকুমেন্ট গুলো লাগিয়ে ফাইল তৈরী করে রাখলাম। তারপর অনলাইন থেকে স্বাক্ষাতের তারিখ নিতে অনলাইন পেমেন্ট করলাম ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। ২৪ মে স্বাক্ষাতের সময় পেলাম ওয়াফি সেন্টার, দুবাইতে। সময়মত সব কাগজপত্র সহ পৌঁছালাম। ১০ মিনিটের মধ্যে আমার ডাক পড়ল। আমার হাতের ছাপ নিয়ে কাগজপত্রগুলো চেক করে নিয়ে নিল আর জানাল ২ সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিক থাকলে পার্সপোর্ট চলে আসবে। ঠিক ২ সপ্তাহ পরে আমি আমার পার্সপোর্ট পেলাম সেঙ্গাইন ভিসা ৩ মাসের মাল্টিএন্ট্রিসহ। এবার কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নায়। দারুন লাগছিল, সব কাজ সহজেই হয়ে গেল।
বন্ধুদের ফোন করে জানতে চাইলাম তাদের কি অবস্থা। তাদের অবস্থা, ইয়ে মানে, তবে, হুম, ওকে, দেখছি। বুঝলাম তাদের দিয়ে এবার হবেনা। শক্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, একলা চলো নীতি। আমি যাবই কেউ আমার সাথে যাক আর নাই যাক। আমার বৌ-বাচ্চা আমার সাথে যেতে পারছেনা কার আমার বাচ্চাটা খুব ছোট আর আমরা যে ট্রিপ এ যাচ্ছি সেটা সলো। সময়ক্ষেপনের সুযোগ নায়। তাদের হয়ত দুবাই রেখে যেতে হবে নতুবা দেশে পাঠাতে হবে মাস খানেকের জন্য।
বৌ-বাচ্চাকে দেশে পাঠায় দিলাম রোজার ঈদের আগে। ঈদের ছুটিতে ট্রিপের জন্য বাজার সদায় করলাম, ছুটিটা পুরোপুরি কাজে লাগালাম। ২০ তারিখ একটু সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম। পাবেল এবং ফারুক আমাই এয়াপোর্টে ছাড়ল। মনে একটু ভয় কাজ করছিল, আমার অনুপস্থিতিতে আমার ব্যবসার কোন ক্ষতি হবে কিনা। এমন একটা ইন্ডাষ্টিতে আছি, খুব হুশিয়ারীতে থাকতে হয়। একটা ভুল একটা মানুষের জীবন নাই হয়ে যেতে পারে।
লুফতেঞ্জা এয়ার ওয়েজ্ আমার কাছে চমৎকার মনে হলো। অনেকবার এমিরেষ্টস এর সেবা নিয়েছি, কিন্তু লুফতেঞ্জার সেবা এমিরেষ্টস এর চেয়ে ভাল ছিল। বিমান ছাড়ার কিছুক্ষণ কর আমার সামনে থাকা এলসিডি স্ক্রিন থেকে আমার মোবাইলটা চার্জে লাগালাম। ভাবছিলাম ইন্টারনেট থাকলে ভালই হত। মোবাইলে দেখলাম ওয়াই ফাই দেখা যাচ্ছে। ওয়া্ই ফাই কানেক্ট করার পর দেখলাম কিছু ডলার চাইল, তারপর ইন্টারনেট চলছে। ভাবতেই অবাক লাগছে, উড়োজাহাজে ইন্টারনেট চলছে। ঘন্টা ঘানিক পর মাল্টিমিডিয়ায় খুঁজে পেলাম একটা ইংরেজী ফ্লিম “ফোকাস”। দারুন একটা মুভি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়লাম। দুবাই থেকে জার্মানি পৌছাতে ৭ ঘন্টার মধ্যে ৩বার খাবার দেওয়া হল। ২বার ভেজা গরম তাওয়েল। জার্মানী থেকে আমার ফ্লাইট বদল করতে হবে ইউ.কে এর। ২০ মিনিট লাগল নির্দিষ্ট গেইট খুঁজে পেতে। তার পর আবার জার্মানী থেকে লন্ডন ২ ঘন্টার সফর।
লন্ডন এয়ার পোর্টের সাথেই মেট্রো লাগানো। একটা মোবাইলের সীম কিনলাম ফ্লাইট থেকে নেমেই। তারপর ট্রেনে চেপে বসলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
সাধারণত আমি একটা দেশ থেকে অন্য আরেকটা দেশে গেলে মাথাটা একটু ঘুরে। পূর্ব-পশ্চিম দিকগুলো সাধারণত এলোমেলো লাগে। লন্ডন পৌঁছানোর পর আমার এই অনুভুতিটা হয়নি। মনে হচ্ছিল দুবাইতেই আছি। সবকিছু খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র আবহাওয়াটা ছাড়া। আবহাওয়াটা ১৮ ডিগ্রি অস্বাভাবিক রকম সুন্দর।